জানুয়ারি ৩০, ২০১৮ ২০:২৩ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৫১

হিজরি তৃতীয় শতক থেকে পঞ্চম শতাব্দি পর্যন্ত অনেক বড়ো বড়ো মুফাসসিরের আবির্ভাব ঘটেছে। এঁদের মধ্যে 'আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন জারির তাবারি'র নামটি সবার আগে উল্লেখ করার মতো।

তাবারি ছিলেন একাধারে ইতিহাসবিদ, ফকিহ, মুহাদ্দিস। হিজরি ২২৪ সালে তিনি ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় অমোল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর সমকালে প্রচলিত অধিকাংশ বিদ্যাতেই পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তাবারি প্রথমদিকে ছিলেন শাফেয়ি ফিকাহর অনুসারী, তবে পরবর্তী পর্যায়ে তিনি নিজেই স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র একটি ফিকাহর আদর্শিক ধারার প্রবর্তন করেন এবং এরপর আহলে সুন্নাতের আর কোনো ফিকাহর অনুসরণ করেন নি।

তাবারির ফেকহি মাযহাবের অনুসারী একটা সময় পর্যন্ত ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা বিলীন হয়ে যায়। 'জামেউল বায়ান' নামে তাবারির তাফসির হিজরি ২৭০ সালে শেষ হয়। এই তাফসিরটি বেশ দ্রুত খ্যাতি লাভ করে এবং মানসুর বিন নূহ সামানি'র আমলে ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়।

 ফার্সি ভাষায় অনূদিত তাবারির তাফসিরটি কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিষয়ক বিদ্যার ক্ষেত্রে প্রাচীনতম ফার্সি ভাষার তাফসিরগুলোর একটি হিসেবে পরিগণিত। তাফসির বিদ্যায় পারদর্শী মনীষীগণ তাবারির জ্ঞানগত ব্যাপক উচ্চতার প্রশংসা করেছেন। তাঁর লেখা তাফসিরটি তাবারির পরবর্তীকালের মুফাসসিরদের জন্যে অনুসরণীয় হিসেবে গণ্য। তাবারি এই তাফসিরটি রচনার ক্ষেত্রে হাদিস বর্ণনার স্টাইল অনুসরণ করেছেন তবে বুদ্ধিবৃত্তিক তাফসির রচনা পদ্ধতিকেও কম গুরুত্ব দেন নি। তাবারি তাঁর এই তাফসিরটিতে তাঁর পূর্ববর্তী মুফাসসিরগণের বক্তব্য উদ্ধৃত করার পর তাঁদের সম্পর্কে নিজের বক্তব্য ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন এবং এক অংশকে অন্য অংশের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। হিজরি তৃতীয় শতকে তাবারির পদ্ধতিটি কোরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে বড়ো ধরনের একটি পদক্ষেপ ছিল। অবশেষে ৩১০ হিজরিতে তিনি ইরাকের বর্তমান রাজধানী বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন।

হিজরি চতুর্থ শতকের অপর একজন বিখ্যাত মুফাসসির হলেন 'আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম নুমানি'। তিনি ছিলেন বিখ্যাত শিয়া আলেম শেখ ইয়াকুব কোলেইনি'র ছাত্র। তাফসিরে নুমানি বর্ণনা এবং বক্তব্যের স্টাইলের দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। লেখক এই গ্রন্থটিকে আটান্নটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন এবং বিষয় ভিত্তিক পদ্ধতিতে কোরআনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাফসিরের ভূমিকায় তিনি জ্ঞান অন্বেষীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কোরআনের আয়াতের তাফসির বুঝতে হলে আহলে বাইতের নিষ্পাপ ইমামদের মাধ্যমে কৃত কোরআনের ব্যাখ্যা যেন অনুসরণ করা হয়। তাঁর বক্তব্য হলো ওহি এবং নবুয়্যতের খান্দানই কোরআনে মাজিদের ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে বেশি সচেতন। এই তাফসিরের একাংশে নবীজীর আহলে বাইতের মাধ্যমে কোরআনে কারিমের আয়াতের তাফসির করার ক্ষেত্রে গবেষণা করা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

আরেকজন বিখ্যাত মুফাসসরি হলেন 'আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন হাসান তূসি'। তিনি অবশ্য 'ইসলামের উজ্বল নক্ষত্র' হিসেবেই বেশিরভাগ পরিচিত। হিজরি তিনশ পঁচাশি সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ২৩ বছর বয়সে শেখ তূসি খোরাসান থেকে ইরাকে যান এবং বিখ্যাত শিয়া আলেম শেখ মফিদের খেদমতে হাজির হন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি সে সময়কার শিয়াদের একজন শীর্ষস্থানীয় আলেম ও নেতায় পরিণত হন। তাঁর সময় পর্বের পরেও তিনি দীর্ঘকাল শিয়া আলেমদের কাতারে অগ্রবর্তী হিসেবে ছিলেন। শেখ তূসি তাঁর জীবনের শেষ ক’বছরে বাগদাদে সংঘটিত দুর্ঘটনার কারণে নাজাফে চলে যান। বিখ্যাত এই আলেম নাজাফ ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। হাজার বছর পর এখনো সেই প্রতিষ্ঠানটি তার দ্বীনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁর লেখা 'তাফসিরে তেবইয়ান' শিয়াদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও গবেষণালব্ধ তাফসিরের সর্বপ্রথম উদাহরণ। শেখ তূসি কোরআনের কিসসা এবং পূর্ববর্তী উম্মাতদের ইতিহাসকে এই তাফসিরে উদ্ধৃত করেছেন এবং সেগুলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে যা কিছু দুর্বল বলে মনে করেছেন সেগুলোকে বাদ দিয়েছেন।

তেবইয়ান এবং তাবারসি'র 'মাজমাউল বায়ান'কে শিয়াদের বিখ্যাত দুটি তাফসির গ্রন্থ হিসেবে মনে করা হয়।শেখ তূসি তাঁর তাফসিরের ভূমিকায় তাঁর তাফসির বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন। ভূমিকা তিনি যে বিষয়টির প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো কোরআন বোধগম্য একটি গ্রন্থ,তবে ভালোভাবে উপলব্ধি করার জন্যে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাগুলোর সাহায্য নেওয়া উচিত। যাই হোক বিখ্যাত মুফাসসির শেখ তূসি শেষ পর্যন্ত হিজরি ৪৬০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

অপর একজন মুফাসসিরে কোরআন হলেন ফায্‌ল বিন হাসান তাবরাসি। তিনি অবশ্য শেখ তাবরাসি নামেই বেশিরভাগ পরিচিত। শেখ তাবরাসি হিজরি ৫৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মাজমাউল বায়ান তাঁর লেখা বিখ্যাত তাফসির। লেখার স্টাইল এবং সাহিত্যিক গুণ বিচারে এই তাফসিরটি সবচেয়ে ভালো একটি তাফসির।

তাফসিরটি ইরান, মিশর এবং লেবাননে বহুবার ছাপা হয়েছে। তাবরাসি তাঁর এই দশ খণ্ডের তাফসিরটি লেখার জন্যে আহলে সুন্নাত এবং শিয়া নির্বিশেষে বিচিত্র উৎস এবং তথ্যসূত্র ব্যবহার করেছেন। মহান এই মুফাসসির তাঁর তাফসিরকর্মকে মূলত শেখ তূসির বিখ্যাত আততেবইয়ানের পরিপূরক বলে মনে করতেন। এছাড়াও তাঁর আরো দুটি তাফসির গ্রন্থ রয়েছে। একটি হলো আরবি ভাষায় এক খন্ডে লেখা 'আলকাফিউশ শাফি' এবং অপরটি 'জাওয়ামেউল জামে'। এটিও আরবি ভাষায় লেখা চার খণ্ডে সমাপ্ত। এই তাফসিরটি একদিকে যেমন অর্থঘন সংক্ষিপ্ত ও অলংকার সমৃদ্ধ ভাষায় লেখা তেমনি কোরআনের আয়াতগুলোতে বিদ্যমান সন্দেহ বা অস্পষ্টতাগুলো সনাক্ত করা হয়েছে। মাজমাউলি বায়ানকে তাফসিরে কাবির এবং জাওয়ামেউল জামে'কে তাফসিরে ভাসিত আর 'আলকাফিউশ শাফি'কে তাফসিরে ভাজিয বলে অভিহিত করা হয়।

আবুল ফাতুহ রাযি, মুহাম্মাদ বিন ওমর ফখরুদ্দিন রাযি এবং মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আনসারি কুরতুবি আরো কজন বিখ্যাত মুফাসসির। আবুল ফাতুহ রাযি হিজরি ৫৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নিশাবুরী বংশোদ্ভুত,তবে রেই শহরে বসবাস করেছেন। রাযি ছিলেন একজন শিয়া মুফাসসির। তাবরাসি এবং যামাখশারির সমকালীন এই মুফাসসির শেখ তূসির ছাত্রদের কাছে পড়ালেখা করেন। রাওযুল জিনান ওয়া রুহুল জানান' তাঁর লেখা বিখ্যাত একটি তাফসির গ্রন্থ। ফার্সি ভাষায় লেখা শিয়াদের তাফসিরের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত তাফসির এটি। ফাখরে রাযি নামে খ্যাত মুহাম্মাদ বিন ওমর ফখরুদ্দিন রাযি হিজরি ৫৪৩ সালে ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় মযান্দারনে জন্মগ্রহণ করেন। অবশ্য তিনি রেই শহরে জীবনযাপন করেছিলেন। হেরাত এবং খাওয়ারেযম সফর করেন। সমকালে তিনি ছিলেন ব্যাপক খ্যাতিমান। ফাখরে রাযির বিখ্যাত তাফসির বিষয়ক বইগুলোর মাঝে মাফাতিহুল গায়েব এবং তাফসিরে কাবির উল্লেখযোগ্য। মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আনসারী কুরতুবি ছিলেন মালেকি মাজহাবের বিখ্যাত একজন আলেম। তিনিও ছিলেন নামকরা একজন মুফাসসির। আল জামেউলি আহকামুল কোরআন তাঁর লেখা বিখ্যাত তাফসির। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ৩০