ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৮ ২১:১৭ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৫৩

গত কয়েকটি আসরে আমরা 'এলমে তাফসির' এবং কয়েকজন বিখ্যাত মুফাসসিরের সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। ইসলামী জ্ঞানের আরেকটি সমৃদ্ধ শাখা হচ্ছে এলমে হাদিস। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশে এলমে হাদিসের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের আসরে আমরা তাই এলমে হাদিস এবং এক্ষেত্রে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের ক'জনের সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করবো।

হাদিসের আভিধানিক অর্থ হলো তরতাজা বা নতুন যে কোনো বস্তু। আর ইসলামী জ্ঞানের পরিভাষা অনুযায়ী হাদিসের অর্থ হলো রাসূলে খোদা (সা.) কিংবা মহান কোনো দ্বীনী মনীষী বা বুযুর্গের বর্ণনা, বক্তব্য, সম্মতি ইত্যাদি। আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে এই বুযুর্গানে দ্বীন হলেন সাহাবা, তাবেয়িন আর শিয়াদের দৃষ্টিতে নবীজীর আহলে বাইতের নিষ্পাপ ইমামগণ। অন্যভাবে বলা যায় এলমে হাদিস হলো এমন কিছু নীতিজ্ঞান যার মাধ্যমে হাদিসের মূলপাঠ এবং সনদের অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। আপনারা জানেন যে নবীজীর যুগে মুসলমানরা তাঁর বক্তব্যগুলোকে সঞ্চয় করতেন এবং উদ্ধৃত করতেন, আর রাসূলে খোদা (সা.)ও এ কাজে তাঁদেরকে উৎসাহিত করতেন। এ সম্পর্কে নবীজী বলেছেনঃ "আমার উম্মাতের মধ্য থেকে যে-ই মানুষের দ্বীনী প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত চল্লিশটি হাদিস সংরক্ষণ করবে, কিয়ামতের দিন সে আলেম এবং ফকিহ হিসেবে গণ্য হবে।"

উল্লেখ্য যে, মুসলমানরা দ্বীনী বিষয় আশয়ে রাসূলে খোদার দিকনির্দেশনার মুখাপেক্ষি তো ছিলেনই, এর বাইরেও তাঁরা নবীজীর হাদিস সংগ্রহ ও সঞ্চয় করা এবং সেগুলো বর্ণনা করার ব্যাপারে উৎসাহ বোধ করতেন। এ কারণে তাঁরা সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়িনদের কাছ থেকে হাদিস শুনতে দূর-দূরান্তে, শহর থেকে শহরে সফর করতেন। কিন্তু রাসূলে খোদা (সা.) এর ওফাতের পর সাহাবিদের অনেকেই এ রকম ভাবছিলেন যে, কোরআনই মুসলমানদের জন্যে যথেষ্ট, তাই রাসূলের হাদিসের বর্ণনা কিংবা সংকলনের প্রয়োজন নেই। এ কারণে সাহাবিদের সংগৃহীত এবং লিখিত বহু হাদিস নষ্ট করে ফেলা হয়। আবার বহু সাহাবি হাদিস সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যমী ভূমিকা পালন করেন। বর্ণনা পদ্ধতি এবং হাদিসের সনদ পর্যালোচনা করতে গিয়ে ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কটি শাখার জন্ম হয়। এলমে 'রেজাল' এবং 'এলমে দেরায়াহ' হাদিস শাস্ত্রেরই গুরুত্বপূর্ণ দুটি জ্ঞানের শাখা। এলমে 'ফেকহুল হাদিস'ও এ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি শাখা। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে হাদিসের তাফসির এবং পর্যালোচনা করার মাধ্যমে হাদিসের মূল লক্ষ্য আবিষ্কার করাই এলমে 'ফেকহুল হাদিসের' উদ্দেশ্য। অনেক মুসলিম আলেম এ ক্ষেত্রে ব্যাপক শ্রম দিয়ে হাদিসকে ছেঁকে নিয়ে বাহুল্য বর্জিত করেছেন।

সামগ্রিকভাবে হাদিসকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-হাদিসে মুতাওয়াতের এবং হাদিসে খাবারে ওয়াহেদ। মুতাওয়াতের হাদিস হচ্ছে যে হাদিসের বর্ণনাকারী অনেক এবং যথার্থতার ব্যাপারে নিশ্চয়তা রয়েছে। খাবারে ওয়াহেদের বর্ণনাকারী মুতাওয়াতিরের সমান নয়, একজন কিংবা কয়েকজনও হতে পারে। শিয়াদের কাছে অবশ্য হাদিস চার প্রকারঃ সহিহ, হাসান, মুয়াসসাক এবং জায়িফ। আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতেও হাদিস সহিহ, হাসান এবং যায়িফ-এই কয় ভাগে বিভক্ত। শিয়া এবং সুন্নি মুহাদ্দিসদের অনেকেই হাদিস সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যাপক শ্রম দিয়েছেন। আজকের আসরে আমরা সুন্নি মুহাদ্দিসগণের হাদিস সংগ্রহ ও সংকলন সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করবো। পরবর্তী আসরে শিয়া মুহাদ্দিসগণের প্রচেষ্টা তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।

হিজরি তৃতীয় শতকে হাদিসের কিতাবগুলো সংকলিত এবং সম্পাদিত হয়। আহলে সুন্নাতের হাদিস গ্রন্থগুলোর মাঝে ছয়টি গ্রন্থ বিখ্যাত। এগুলো 'সিহহা সিত্তা' অর্থাৎ সহিহ ষষ্ঠক নামে পরিচিত। আহলে সুন্নাতের মুহাদ্দিসগণের মাঝে 'আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইসমাইল বোখারি'র নাম সবার আগে উল্লেখ্য। হিজরি ১৯৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বোখারা অর্থাৎ বর্তমান উজবেকিস্তানের বাসিন্দা ছিলেন। হাদিস শোনার জন্যে তিনি খোরাসান, ইরাক, হেজাজ, সিরিয়া এবং মিশর সফর করেন। অবশেষে তিনি ছয় লক্ষ হাদিস থেকে সহিহ হাদিসের একটি সংকলন করেছেন 'সহিহ বোখারি' নামে। এ কাজে তাঁর ষোলো বছর সময় লেগেছে। আহলে সুন্নাত সহিহ বোখারিকে কোরআনের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ গ্রন্থ বলে মনে করে। ২৫৬ হিজরিতে বোখারি সামারকান্দে মৃত্যুবরণ করেন।

আহলে সুন্নাতের অপর বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থটি হলো 'সহিহ মুসলিম'। 'মুসলিম বিন হাজ্জাজ কুশায়রি' ২০৪ হিজরিতে ইরানের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় শহর নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলা থেকেই তিনি দ্বীনী শিক্ষা লাভ করেন এবং হাদিস শোনার জন্যে, সংগ্রহ করার জন্যে বিভিন্ন শহর সফর করেন। তিনি বোখারির একজন ঘনিষ্ঠ ছাত্র ছিলেন। আহলে সুন্নাত সহিহ মুসলিম'কে বোখারি শরিফের পর মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বলে মনে করেন। সহিহ বোখারি ও সহিহ মুসলিমের হাদিসকে আহলে সুন্নাত সনদ পর্যালোচনা ছাড়াই বিশুদ্ধ বলে মনে করেন। বিখ্যাত এই মুহাদ্দিস ২৬১ হিজরিতে নিশাবুরেই মৃত্যুবরণ করেন।

'সুনানে আবু দাউদ সাজেস্তানি'ও হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাতের অপর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। তাঁর প্রকৃত নাম হলো 'সোলাইমান বিন আশআস'। তিনি হাদিস শোনার উদ্দেশ্যে নিজের জন্মভূমি থেকে মোটামুটি মুসলিম বিশ্বের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সকল অঞ্চলেই সফর করেছেন। বিশেষ করে বাগদাদে গিয়ে আহমাদ বিন হাম্বলের কাছ থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছেন। বোখারি এবং মুসলিম শরিফের পর তাঁর হাদিস গ্রন্থটিরই গুরুত্ব বেশি।

আহলে সুন্নাতের কাছে অপর বিখ্যাত হাদিস সূত্র হলো 'সুনানে ইবনে মাজাহ'। তাঁর পুরো নাম 'আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইয়াযিদ ইবনে মাজাহ ক্বাজভিনি'। তিনিও হাদিস শোনার উদ্দেশ্যে বহু শহর সফর করেন এবং সবশেষে ইরানের ক্বাজভিন শহরে এসে অবস্থান নেন। সেখানে তিনি শিক্ষকতা করেন এবং লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। 'সুনানে তিরমিযি'ও আহলে সুন্নাতের আরেকটি নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থ। এই হাদিস গ্রন্থটির সংকলক হলেন 'মুহাম্মাদ বিন ইসা তিরমিযি'। অন্যান্য হাদিসগ্রন্থের বাইরে তিরমিযি শরিফে ঐতিহাসিক এবং বিশ্বাসগত বিভিন্ন বিষয়ও স্থান পেয়েছে। এজন্যে তিরমিযি শরিফকে 'আলজামেউস সহিহ' হিসেবেও গণ্য করা হয়। তিরমিযি শরিফের প্রতিটি বর্ণনার পর ঐ হাদিসটি সহিহ কি জায়িফ-সে সম্পর্কে পর্যালোচনা রয়েছে।

আহলে সুন্নাতের আরো একটি হাদিস সূত্র হলো 'সুনানে নাসায়ি'। এটির সংকলক হলেন 'আবু আব্দুর রাহমান আহমাদ বিন শুয়াইব নাসায়ি'। তাঁর সংকলিত সহিহ হাদিস গ্রন্থটির নাম মূলত 'আলমুজতাবা মিনাস সুনান'। তিনি ইমাম আলি (আ) এর ফযিলত সম্পর্কেও একটি কিতাব লিখেছেন। ঐ কিতাবটির নাম হলো "আল-খাসায়েস"। পরবর্তীকালে আহলে সুন্নাতের আলেমগণ এই সিহহা সিত্তার ওপর ব্যাখ্যামূলক আরো অনেক বই পুস্তক লিখেছেন। "আল-ইলযামাত" এই শ্রেণীর বিখ্যাত একটি গ্রন্থ। এটি লিখেছেন 'আবুল হোসাইন আলী বিন ওমার বিন আহমাদ'। তিনি অবশ্য দারে কুতনি নামেই বেশি পরিচিত। তাঁর গ্রন্থটিতে এমন কিছু রেওয়ায়েত আছে যেগুলো বোখারি এবং মুসলিমের মতে সহিহ হলেও তাঁদের সহিহ গ্রন্থ দুটিতে ঐ বর্ণনাগুলো আসে নি। আরেকটি বই হলো হাকিম নিশাবুরির "আলমুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন"। জায়িফ হাদিস সনাক্ত করাসহ হাদিস সম্পর্কে সামগ্রিক একটা তদন্তের চেষ্টা করা হয়েছে এই গ্রন্থটিতে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ৪