জুলাই ১৮, ২০১৮ ২০:৪১ Asia/Dhaka

কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে সূরা আল আহযাবের ৩৫ থেকে ৩৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا (35)

“নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ ও ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ ও রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকিরকারী পুরুষ ও অধিক যিকিরকারী নারী- তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।” (৩৩:৩৫)   

এই আয়াতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আমলের দিক দিয়ে একজন পরিপূর্ণ মানুষের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার পথে নারী বা পুরুষভেদে কোনো অন্তরায় নেই বরং যে কেউ দৃঢ় সংকল্প করলেই আল্লাহ তায়ালার খাঁটি বান্দায় পরিণত হতে পারে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা, জিহ্বা, উদর ও যৌনাকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করা, অভাবী মানুষের প্রয়োজন মেটানো, বিপদ-আপদে ধৈর্য্য ধারণ করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা এবং একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করার ক্ষেত্রে যে যত অগ্রগামী সে আল্লাহর কাছে তত বেশি প্রিয়। অনেকে ধারনা করেন, কেউ শুধু নামাজ আদায় ও রোজা পালন করলেই ঈমানদার হয়ে যায়। তাদের সে ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য এই আয়াতে ধর্মীয় ফরজ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ধৈর্য্য ধারণ, সত্যবাদিতা এবং বিনয়ী হওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কাজেই এসব বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে যত কম থাকবে তার ঈমান তত দুর্বল।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে:

১. নারী ও পুরুষের পার্থক্য শুধু দেহের গঠনপ্রণালিতে কিন্তু খাঁটি ঈমানদার হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ মানুষের আত্মার ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই।

২- ইসলামের দৃষ্টিতে সেই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মানুষ বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আমলের দিক দিয়ে যার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে।

সূরা আহযাবের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا (36)

"আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন (কিছু করার) ক্ষমতা নেই।  যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।” (৩৩:৩৬)

আগের আয়াতের সূত্র ধরে এই আয়াতে ঈমানদার নারী-পুরুষের আনুগত্যের ওপর আরো বেশি জোর দিয়ে বলা হয়েছে, মুমিন ব্যক্তিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ইচ্ছাকে নিজের ইচ্ছার উপর প্রাধান্য দিতে হবে। যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন বলে দাবি করে সে কখনো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পরিপন্থি কোনো কাজ করতে পারে না। কারণ সে জানে এটা করলে তাকে পথভ্রষ্ট হতে হবে।

মূলত প্রকৃত ঈমানের বিষয়টি নির্ভর করে আল্লাহর আদেশ-নিষেধের সামনে শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পনের ওপর। কাজেই কেউ যদি নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী আল্লাহর নির্দেশের একাংশকে গ্রহণ এবং অন্য অংশ বর্জন করে তাহলে সে আল্লাহর আনুগত্য করেনি বরং নিজের খেয়াল-খুশির আনুগত্য করেছে।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন প্রকৃত ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য।

২. আল্লাহর নির্ধারিত কাঠামোর মধ্যে স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার মুমিনের রয়েছে। লাগামহীন স্বাধীনতা গ্রহণযোগ্য নয়।

৩. মানবসৃষ্ট যেসব আইন আল্লাহর আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সেগুলো মেনে চললে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।

সূরা আহযাবের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِي أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَاتَّقِ اللَّهَ وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَاهُ فَلَمَّا قَضَى زَيْدٌ مِنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ مَفْعُولًا (37) مَا كَانَ عَلَى النَّبِيِّ مِنْ حَرَجٍ فِيمَا فَرَضَ اللَّهُ لَهُ سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًا (38)

“আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; (স্মরণ করুন) তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও (তালাক দিও না) এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ পাক প্রকাশ করে দেবেন আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়েদ যখন তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।” (৩৩:৩৭)

“আল্লাহ নবীর জন্যে যা নির্ধারণ করেন, তাতে তাঁর কোন বাধা নেই। পূর্ববর্তী নবীগণের ক্ষেত্রেও এটা ছিল আল্লাহর চিরাচরিত বিধান। আল্লাহর আদেশ নির্ধারিত, অবধারিত।” (৩৩:৩৮)

বর্ণনায় এসেছে, যেইদ নামে বিবি খাদিজা সালামুল্লাহি আলাইহার একজন ক্রীতদাস ছিল। বিয়ের পর তিনি যেইদকে উপহার হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে দিয়ে দেন।  আল্লাহর রাসূল যেইদকে প্রথমে মুক্ত করেন এবং পরে নিজের পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর তিনি নিজের ফুফাতো বোন জয়নাবের সঙ্গে যেইদের বিয়ে দেন। কিন্তু এই দুজনের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। আল্লাহর রাসূল জয়নাবকে তালাক না দেয়ার জন্য যেইদকে উপদেশ দেয়া সত্ত্বেও এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। এই বিপর্যয়ের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) যয়নাবকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন।  কিন্তু নিজের পোষ্যপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করলে লোকে কি বলবে এই শঙ্কায় তিনি ইতস্তত করছিলেন। আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের যুগে এই কাজ ছিল নোংরা ও অপছন্দনীয়। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ কুরআনের আয়াত নাজিল করে বলেন: আপনি এই কাজ করুন যাতে অন্ধকার যুগের এই কুসংস্কারটি সমাজ থেকে দূরীভূত হয়।  আপনি লোকনিন্দাকে ভয় পাবেন না। কারণ, সমাজে প্রচলিত ভুল ধারনা সংশোধন করার জন্যই যেমন অতীতে নবী-রাসূলদের পাঠানো হয়েছিল তেমনি আপনারও দায়িত্ব সমাজের ভুল সংস্কারগুলো সমূলে উৎপাটন করা।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতবিরোধ হলেই তালাক বা বিচ্ছেদের চিন্তা করা যাবে না এবং অন্যকেও এই কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

২. কারো দাম্পত্য কলহের খবর কানে এলে তাদেরকে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের উপদেশ দিতে হবে। তারা যেন আল্লাহকে ভয় করে ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকে। কারণ, তাকওয়া অর্জন করলে দাম্পত্য জীবনের বন্ধন দৃঢ় হয়।

৩- আল্লাহর হুকুম-আহকাম পালনের ক্ষেত্রে লোকলজ্জাকে ভয় না করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে প্রাধান্য দিতে হবে।

এবং

৪- সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং এক্ষেত্রে দুষ্ট লোকের হট্টগোল সৃষ্টির চেষ্টাকে ভয় পেলে চলবে না।#