সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৮ ১৬:৩৭ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৮৩ : তুরস্কে ইসলামী জাগরণ প্রক্রিয়া

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত আসরে আমরা তুরস্কে ইসলামী জাগরণের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। সেইসাথে ইসলামী জাগরণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন দিক নিয়েও কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম।

আমরা তুরস্কে ইসলামী জাগরণ প্রক্রিয়া নিয়েই আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।

তুরস্কে অন্যান্য যেসব আন্দোলন বা ধারা বহমান ছিল সেগুলোর মধ্যে সচেতনভাবে ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা ছিল অন্যতম। এই প্রবণতার সূত্রপাত হয়েছিল সংবাদপত্র প্রকাশনা বিশেষ করে ‘সাবিলুর রাশাদ’ নামের ইসলামী পত্রিকাটি প্রকাশের পর থেকে। এই পত্রিকাটি আরবি ভাষায় বের হতো। এই ধারার কয়েকজন উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি হলেন ইসমাইল হাক্কি আযমিরি, আহমাদ নায়িম ববন যাদেহ, মুহাম্মাদ আকেফ (এরসুয়ি) এবং শারফুদ্দিন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে ইসলাম মানে শুধুমাত্র ইমানই নয় বরং ইসলাম হচ্ছে একটি আইন ভিত্তিক জীবন বিধান, গণতান্ত্রিক এবং মানবীয় একটি ধর্ম। এই ধর্মটি মানব জীবনকে সুশৃঙ্ক্ষল এবং লক্ষ্যাভিমুখী করে তোলে। ইসলামের নীতিমালাগুলো মানবাধিকার ঘোষণার মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের দর্শন ও সংস্কৃতি যেভাবে অবক্ষয়ের গভীরে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে সেই দর্শনের প্রভাব থেকে ইসলাম পুরোপুরি মুক্ত।

সময়ের বিবর্তনে এবং সংস্কারকামী ও ধর্মীয় রক্ষণশীল দেলগুলোর মধ্যকার মতপার্থকের কারণে ইসলামপন্থীদের মাঝে বিভক্তি এসে যায়, দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় তারা। একটি হলো ঐতিহ্যপন্থী ইসলাম অপরটি হলো আধুনিকতাপন্থী ইসলাম। তবে ইসলামপন্থী এই দুটো দলই পাশ্চাত্য দর্শন ও সংস্কৃতির ঘোর বিরোধী ছিল। ঐতিহ্যপন্থী ইসলামী ধারায় উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের মধ্যে একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন মোস্তফা সাবরি। মোস্তফা সাবরির মতো ব্যক্তিত্বগণ তিনি সমগ্র বিশ্বকে দারুল ইসলাম এবং দারুল হার্‌ব-এ বিভক্ত করার চেষ্টা করেছেন। সেইসাথে থিয়েটার, ভাস্কর্য, চিত্রশিল্পের বিষয়গুলোকে নিষিদ্ধ করার পক্ষ সমর্থন করতেন।

কিন্তু সংস্কারপন্থী বা আধুনিকতাপন্থী ইসলামী ধারায় বিশ্বাসীরা ঐতিহ্যপন্থীদের সাথে খুব বেশি একাত্ম ছিলেন না। তারা আধুনিক বা সমকালীন সভ্যতা থেকে উত্থিত বিষয় আশয়ের প্রতিই বেশি মনোযোগী ছিলেন। তাঁরা চাইতেন দ্বীনের ইমানী মূলনীতিগুলোর সাথে জ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনীগুলোর সমন্বয় ঘটানোর উপযুক্ত পন্থা আবিষ্কার করতে।  ইসলামী বিধি বিধান বা আইনী ব্যবস্থাকে আধুনিক সমাজ জীবনের প্রয়োজনীয়তা বা চাহিদা অনুযায়ী সাজাতে।

তুরস্কে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। ১৯২৩ সালে তুরস্কে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। ইসলামী জাগরণের সূত্রপাতও হয়েছিল সে সময় থেকে। ওসমানী সাম্রাজ্যভুক্ত ইউরোপীয় ভূখণ্ড রোম ও আনাতোলিয়ার অধিকার রক্ষা সমাজের সাথে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে এবং পশ্চিমা দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইসলামী জাগরণের সূত্রপাত হয়। মোস্তফা কামালসহ আনাতোলিয়ার অধিকার রক্ষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের বিশাল জনগোষ্ঠিকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে এবং তাদেরকে জাতীয় মহাজোটভুক্ত হতে আকৃষ্ট করার জন্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে ‘জেহাদে মোকাদ্দাস’ বা পবিত্র জেহাদ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এভাবেই বহু দ্বীনদার মানুষ, উলামায়ে কেরাম এবং মাশায়েখ এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। এভাবেই তুর্কি সাম্রাজ্যে নয়া প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এ সময়টাতে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করার চেষ্টা চালানো হয় এবং কামাল আতাতুর্কের সময় তা আরো বেশি মাত্রা পায়। ইসলামপন্থীরা এ সময় শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে এবং ১৯২৫ সালের শেখ সায়িদ পিরানের অভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।               

১৯৪৬ সালের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি গঠনের ফলে তুরস্কের আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। এর কারণটা হলো এই দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যুক্ত করা হয়েছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা কিংবা ধর্মীয় শিক্ষা দীক্ষার মতো অতি প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী বিষয়গুলো। এ ছাড়াও ডেমোক্র্যাট পার্টি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মাঝে বিরাজমান অসন্তোষ কমিয়ে আনার জন্যে এবং জনগণকে আকৃষ্ট করার জন্যে বেশ কিছু কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিল। এগুলোর মধ্যে ছিলঃ হজ্ব সফরের স্বাধীনতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় পাঠ দানের ব্যবস্থা করা, ধর্মতত্ত্ব ফ্যাকাল্টি প্রতিষ্ঠা করা এবং ধর্মীয় বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা ইত্যাদি। ১৯৫০, ১৯৫৪ এবং ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাট পার্টি বিপুল ভোটে বিজয়ের ঘটনায় ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি মানুষের বিশ্বাসের ওপর আঘাতের মাত্রা কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল।

একদলীয় শাসন অবসানের পর দলে দলে মানুষ মসজিদমুখী হয়। বহু মসজিদ মেরামত কিংবা পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং নতুন নতুন অনেক মসজিদ নির্মাণও করা হয়। আরবি ভাষায় লেখা যেসব ধর্মীয় বই পুস্তক জোর করে আড়াল করা হয়েছিল সেইসব বই মানুষের ঘরে ঘরে দেয়ালের তাকে তাকে নতুন সাজে শোভা পেতে শুরু করে। পত্র পত্রিকাগুলোতে রাজনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক করার সপক্ষে লেখালেখির পরিবর্তে ধর্মীয় বিষয় আশয়ে লেখালেখি গুরুত্বের সাথে ছাপা হতে শুরু করে। এই ডেমোক্র্যাট পার্টির বিরুদ্ধে ১৯৬০ সালে অভ্যুত্থান হয়। ঐ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের দশ বছরের শাসনের অবসান হয় এবং শাসকদের বিচারের সম্মুখিন করা হয়।

ইসলাম পন্থীরা ১৯৭০ সালে ‘নেজামে মিল্লি’ নামে দল গঠন করে আবারো প্রকাশ্যে আন্দোলনের রাজপথে নেমে আসে। এই দলটি সংসদের ৪৪টি আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। তুরস্কের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই দলটির প্রবেশের মধ্য দিয়ে তুরস্কের রাজনৈতিক ইসলামের ইতিহাস একটি নতুন মোড় নেয়। এই আন্দোলনের ফলেই পরবর্তীকালে ইসলামপন্থীদের নতুন আরেকটি দলের সৃষ্টি হয়। নাজমুদ্দিন আরবাকান ছিলেন ইস্তাম্বুল কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। একইসাথে তিনি ছিলেন তুরস্কের শিল্প, বাণিজ্য ও চেম্বার অব কমার্স ইউনিয়নের প্রধান। এর বাইরেও তাঁর আরো বড়ো পরিচয় হলো তিনি ছিলেন নেজামে মিল্লি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। এই দলটির বিলুপ্তির পর ১৯৭৩ সালে তিনি ‘সালামাতে মিল্লি’ নামক পার্টি গঠন করেছিলেন। তাঁর দল সংসদের ৪৮টি আসন পেয়ে সংসদে তৃতীয় প্রধান দল হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে যায়। এভাবেই তিনি তখনকার উপপ্রধানমন্ত্রীত্বের পদ লাভ করতে সক্ষম হন। আরবাকান উপপ্রধানমন্ত্রী হবার সুবাদে সালামাতে মিল্লি পার্টির বহু সদস্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যাবার পথ সুগম হয়। তুরস্কের সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছিলেন আরবাকান।

যাই হোক এরপর তাঁর দলও ১৯৮০ সালে ইরানের বিপ্লবের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজপথে নেমে এলে সরকার তাঁর দলকে বিলুপ্ত করে এবং তাঁকে নির্বাসনে পাঠায়।  এরপর তিনি ফিরে এলে এবং কারামুক্ত হবার পর ‘হেযবে রেফাহ’ নামে আরেকটি দল গঠন করেন। আশির দশকে দ্বীনী কার্যক্রমের উন্নয়ন ঘটে। ১৯৯৫ সালের নির্বাচনে হেযবে রেফা সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় এবং আরবাকান সরকার গঠন করেন। কিন্তু সামরিক বাহিনী তাঁর নীতির বিরোধিতা করে এবং ১৯৯৭ সালে তাঁকে বরখাস্ত করে। তাঁর দলকেও কিছুদিন পর বাতিল করে। কিন্তু তাঁর সমচিন্তার লোকেরা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নামে নতুন দল গঠন করে। রজব তাইয়্যেব এরদোগানের নেতৃত্বে এই দল ২০০০ সালে ক্ষমতা লাভ করার মধ্য দিয়ে আরবাকানের নীতি ও কর্মসূচিগুলো পুনরায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। যদিও তাঁর কিছু কিছু কর্মসূচি সমালোচিতও হয়। সেদেশের গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে সেখানে ইসলামী চিন্তাদর্শ প্রচারের কাজ ব্যাপকভাবে চলছে। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ৭

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন