সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮ ১৭:২৯ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৮৮ : দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইসলামী জাগরণের ইতিহাস

মালয়’ নামে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বড়ো একটি উপদ্বীপ রয়েছে। সিঙ্গাপুরসহ মালয়েশিয়া, বার্মা বা মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডের কোনো কোনো অংশ জুড়ে এই উপদ্বীপটির অবস্থান।

খ্রিষ্টিয় তেরো শতকের শেষাংশে এবং চৌদ্দ ও পণরো শতকে ইসলামী দ্বীনী আদর্শ ভারত ও আরব উপদ্বীপ থেকে এই মালয় উপদ্বীপ আর ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে আসতে শুরু করেছিল। খ্রিষ্টীয় পণেরও শতাব্দীতে এবং খ্রিষ্টীয় ষোলো শতকের শুরুর দিকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ইসলাম দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃতি লাভ করে। এই অঞ্চলে ইসলামের প্রবেশ এবং বিস্তার ঘটেছিল বাণিজ্যের পথ ধরে এবং সুফি সাধকদের মাধ্যমে। আবার মালয় উপদ্বীপ, সুমাত্রা এবং জাভা দ্বীপাঞ্চল থেকে শুরু করে ফিলিপাইন পর্যন্ত ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। কেননা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইসলামী সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল স্থানীয় সংস্কৃতি। ধর্মীয় আকিদা বিশ্বাস এবং শৈল্পিক অর্জন বিশেষ করে নিজস্ব শিল্পের ভিত্তিমূলে স্থাপিত ছিল সেই সংস্কৃতি।

এ অঞ্চলের মুসলমানরা সবসময় নিজেদের দেশে বিদেশীদের উপস্থিতির বিরোধী ছিল। এ কারণেই ১৫১১ সালে মালয়-তে এবং ১৫২২ খ্রিষ্টাব্দে মুলুক দ্বীপে পর্তুগিজদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে মুসলমানরা ব্যাপক সংগ্রাম করেছিল। সতেরো শতকেও তারা হল্যান্ডিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে হল্যান্ডিরা মালয়ের পশ্চিমাঞ্চলীয় মালাকা দ্বীপ দখল করে নিয়েছিল। আবার আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে তারা পূর্ব ভারত দ্বীপ তথা বলা যেতে পারে বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার ওপর নিজেদের আধিপত্য বা উপনিবেশ স্থাপন করে। এভাবে তারা এই অঞ্চলের মশলাপাতি ব্যবসার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সক্ষম হয়। এই বিশাল এলাকার ওপর হল্যান্ডিদের বাণিজ্যিক শাসন কায়েম থাকার পরও মুসলমানরা উনিশ শতক পর্যন্ত নিজেদের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ বা পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিল। আঁচেহ, মালয়, মিনাং কাবাউ এবং জাভার মতো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোর প্রত্যেকটিতে বিশেষ ইসলামী সমাজ গড়ে উঠেছিল। সেই মুসলিম সমাজ একদিক থেকে যেমন অপরাপর মুসলিম সমাজের মতোই ছিল তেমনি অপরদিকে কোনো কোনো দিক থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারীও ছিল।

১৮১৯ সালে  ব্রিটিশ বাহিনীও মালাকা প্রণালী দখল করে নিয়েছিল। এ সময় তারা সিঙ্গাপুরে নতুন করে একটি ঘাঁটিও নির্মাণ করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে তারা সমগ্র মালয়ব্যাপী তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসেছিল। হল্যান্ড সরকারও ১৯১১ সালের মাথায় পূর্ব ভারতের সমগ্র দ্বীপাঞ্চল তথা ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ওপর প্রথমবারের মতো  নিজেদের পরিপূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এই পুরো অঞ্চলের ওপর একক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল তারা।

ইন্দোনেশিয়া হলো সহস্রাধিক দ্বীপের সমষ্টি। এই ইন্দোনেশিয়ায় ধীরে ধীরে ইসলামী জাগরণের সূচনা এবং বিকাশ ঘটে। এই দেশে ইসলামী জাগরণের পাশাপাশি সামাজিক কিছু স্বাধীন সংস্থা ও সংগঠনও ছিল যারা তখনকার সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। আমরা সেইসব আন্দোলন এবং আন্দোলনকারী ব্যক্তিত্বদের নিয়ে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। এবারে চলুন খানিকটা বিরতিতে যাওয়া যাক।

ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জাগরণের কথা বলছিলাম। সুন্নি আলেম ওলামা, রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণ, সূফীগণ, বুদ্ধিজীবী এবং বিভিন্ন পর্যায়ের সংগঠন বা সংস্থার পরিচালকগণ চেয়েছিলেন নিজেরাই তাঁদের নিজেদের দেশের ভবিষ্যৎ গঠন করবেন। এক্ষেত্রে মুসলমানরাই অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। তাঁরা সর্বপ্রথম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন হল্যান্ডিদের বিরুদ্ধে। মালয়েশিয়ায় পতনোন্মুখ আশরাফদের শাসনের বিরুদ্ধেও তাঁরা বিদ্রোহ করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে মাতারাম বাদশাহী শাসনের স্থায়িত্ব বিধান করা থেকে সতেরো শতকের সূচনালগ্নে জাভার আশরাফ এবং সম্পদশালীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ কেন্দ্রিক আশরাফ এবং সম্পদশালী এলিটদেরকে ‘পুরিয়া’ বলা হতো। আর দ্বীনদার আশরাফদের বলা হতো ‘কিয়ায়ি’। এই কিয়ায়ি’রা হল্যান্ডের উপনিবেশিক শাসনের যুগে পুরিয়ায়িদের দৃষ্টি আকর্ষণের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাভা সমাজে স্বাধীন প্রতিনিধিত্বের সুযোগ লাভ করেছিল। যার ফলে হুকুমাতে তাদের শক্তি এবং সামর্থ্য ও প্রভাব অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

এই পর্যালোচনার বাইরেও মালয় এবং ইন্দোনেশীয় মুসলমানগণ সংস্কারকামী চিন্তা-চেতনার সাথে পরিচিত হন। সেইসাথে তাঁরা ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ এবং মূল্যবোধগুলোর ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হয়ে ওঠেন। হল্যান্ডিদের শাসনের বিরুদ্ধে জাভায় কিয়ায়িরা এবং কৃষিজীবীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৮৪০ এবং ১৮৫০ এর দশকগুলোতে এই এলাকাটিতে ইসলামী জাগরণের সূত্রপাত ঘটে। এর প্রমাণ হিসেবে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। সেইসাথে দ্বীনী মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিভিন্ন ফেরকা এবং ধর্মীয় সংস্থার সদস্য হবার প্রবণতাও বেড়ে গিয়েছিল। তরিকতে কাদেরিয়ার মাধ্যমে মাযহাবি বা ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাথে তাদের অনুসারীদের যোগাযোগ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এই কাদেরিয়া তরিকতের বেশিরভাগ সদস্যই ছিল কিয়ায়িরা। তরিকতপন্থীরা চাইতো কুরআনের বিধি নিষেধগুলো যেন সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। এইরকম আদর্শে বিশ্বাসী তরিকতপন্থীরা ইসলামী আদর্শ প্রচারে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছিল। যার ফলে বিদেশী উপনিবেশবাদীদের মোকাবেলায় দ্বীনী জাগরণমূলক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল।

ইন্দোনেশিয়ায় এই ইসলামী জাগরণের সূচনার ফলে বিদেশী উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে মারাত্মক বিরোধিতা শুরু হয়ে যায়। আর আশরাফরা যেহেতু তাদের সহযোগী ছিল সেজন্যে কৃষিজীবী এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে আশরাফ শ্রেণী বিরোধী মনোভাব এবং ক্ষোভ তুঙ্গে ওঠে। যার পরিণতিতে ১৮৮৮ সালে বিশাল অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছিল। তবে এই অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটেছিল হল্যান্ডি সেনাদের হামলা এবং জাভার নেতৃবৃন্দের পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে। তবে এই অভ্যুত্থানকে ভয়াবহভাবে দমন করেছিল তারা। মিয়াং কাবাউতে পাদ্রি আন্দোলন, ক্যালিমানটানে বানজারমাসিন যুদ্ধ, ১৮৭১ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত আঁচেহ যুদ্ধ ইত্যাদি সেই বিরোধিতারই ঐতিহাসিক প্রমাণ।

কিয়ায়ি এবং কৃষিজীবীদের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের শেকড় ছিল ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত। যার ফলে পুরিয়ায়িরাও পরবর্তী পর্যায়ে বাধ্য হয়েছিল জাতীয় এই গণজাগরণমূলক আন্দোলনে এসে যোগ দিতে। শেষ পর্যন্ত তারাও হল্যান্ডিদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে কিংবা আরো সুস্পষ্টভাবে বলা যায় উনিশ শতকের সূচনালগ্নে জাতীয় আন্দোলন সংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল। এভাবে ইসলামী জাগরণ গতি লাভ করেছিল।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১২

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন