জুলাই ১৩, ২০১৯ ২১:০৫ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের সুশীল সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে চীন আন্তরিক নয়। তাদের বক্তব্য কথার কথা বলে মনে হয়েছে। অথচ রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ সংকট।

  • রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে চীন এখনও আন্তরিক নয়। তারা এখনও ডিপ্লমেটিক কথাবার্তা বলছে।
  • রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের ভাষা কথার কথা বলে মনে হয়।
  • চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হয়ে যেত।
  • রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ইস্যুতে মিয়ানমার সরকার অনেক বেশি অনমনীয়। চীনের প্রশ্রয়ের কারণেই মিয়ানমার এমনটি করার সাহস পাচ্ছে।
  • রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত নানা গভীর সংকট তৈরি হয়েছে
  • নিকট ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে বলে মনে করি না।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান:  জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদ, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীন চেষ্টা করবে। দেশটি সফর শেষে একথা বলেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ইস্যুতে চীন কতটা আন্তরিক বলে আপনার মনে হয়?

সৈয়দ আবুল মকসুদ: দেখুন, চীনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশ মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। কারণ চীনের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক ভালো। তবে স্ট্রাটেজিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামরিক সব  দিক থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বেশি গভীর।

মিয়ানমারের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি ছাড়া বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশের একার পক্ষে এই সংকটের সমাধান করা সম্ভব নয়। আর এ ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যতোটা না করবে তার চেয়ে বেশি প্রত্যাশা চীন, ভারত  ও রাশিয়ার কাছ থেকে। তবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে চীন।

রোহিঙ্গা সংকট

দেখুন, অত্যন্ত মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মিয়ানমারে যখন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মমভাবে গণহত্যা,ধর্ষণ চালানো হয়েছে  তখন যদি আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিতাম তাহলে হয়তো আরও লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিহত হতো, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকারে পরিণত হতো।

জাতিসংঘ থেকে শুরু করে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ একথা স্বীকার করে। মাত্র কয়েকদিন আগেও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে গেছেন।  রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের সবার সমর্থন রয়েছে বাংলাদেশের প্রতি। বর্তমান সময়ে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়িত মানুষ হচ্ছে রোহিঙ্গারা। একথা পৃথিবীর কেউ অস্বীকার করে না।

তো সেই রোহিঙ্গাদের তাদের নিজেদের দেশে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে চীনের মতো সুপার পাওয়ার যদি বিষয়টি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে না পারে সেটা হবে দুঃখজনক। বাংলাদেশ অত্যন্ত ছোটো একটি দেশ। আমাদের ভূমি কম, সম্পদ কম। সেই ছোট্ট একটি দেশে এত বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গারা এসেছে। তাদের কারণে আমাদের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অর্থনীতির ওপরও চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশের জন্য এটা অনেক বড় ক্ষতি। আর বিষয়টি যেকোনো কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের বোঝার কথা। রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের পাবর্ত্য এলাকা আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত দিক থেকে বিপন্ন হতে চলেছে।

চীনের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্কের কথা আমি আগেই বলেছি। সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই চীন সফরের সময় তারা বলেছেন যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে চীন তার সাধ্যমতো সহযোগিতা করবে। সমস্যা জিইয়ে রাখলে বাংলাদেশের সাংঘাতিক ক্ষতি হবে এটুকু চীন নিশ্চয়ই বোঝে। আর সেদিকটি বিবেচনায় নিয়ে চীনের সরকারকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। শুধু যে বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে অনুরোধ করবে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিষয়টি এমনটি নয়;  তাদের এগিয়ে আসা উচিত।

রেডিও তেহরান: চীনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে এককথায় যদি বলতে বলা হয় তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আন্তরিক কি না?

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক সমকক্ষ চায়নার সঙ্গে

সৈয়দ আবুল মকসুদ: আমার ব্যক্তিগত অভিমত এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে তাতে চীন আন্তরিক নয় এটাই প্রতীয়মান হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা দূরের কথা- তারা কূটনীতির ধাচে এ ব্যাপারে কথা বলছে। যেমন- চীন-বাংলাদেশের পাশে থাকবে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করবে ইত্যাদি। তো চীন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যে ভাষায় কথা বলছে সেটা নেহায়েত কথার কথা বলে মনে হয়েছে। প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ল আর সে বিষয়টি চীনের মতো এত বড় একটা শক্তি এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী-তারা যদি খুব সামান্যও চাপ দিত তাহলে ঘটনাটি এই পর্যায়ে যেত না। বিষয়টি বাংলাদেশের নয়; এটি মানবতার বিষয়। আর মানবতার কারণেই বাংলাদেশ অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। মানুষের ওপর এভাবে অত্যাচার চালিয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করার মতো ঘটনা বিরল। আর বড় ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে চীন তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে নি এ ব্যাপারে বা রেহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে দায়িত্ব পালন করে নি।

রেডিও তেহরান:  প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় একটি চুক্তি হয়েছে যার আওতায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ২,৫০০ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করবে চীন। কিন্তু অনেকে বলেন, এ ধরনের সহায়তা নয় বরং রোহিঙ্গাদের নিজেদের ভূমিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কী বলবেন আপনি?

সৈয়দ আবুল মকসুদ: আমিও সম্পূর্ণ একমত। চাল সরবরাহ করা বড় কোনো বিষয় নয়; এটি সাময়িক একটা বিষয়; আমার মনে হয় একেবারেই খুব একটা কার্যকর কোনো অর্থবহন করে না। রোহিঙ্গাদের নিজেদের ভূমিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করাটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে চীনের সঙ্গে তো বাংলাদেশ সরকার কথাবার্তা বলেছে এর বাইরে যে দেশের বিষয় অর্থাৎ মিয়ানমারের সঙ্গে এ জটিল সংকটটি নিয়ে প্রতিবেশীসুলভ যত বেশি চেষ্টা করা যায় সেটাই করা উচিত। আর সেই চেষ্টাটি বাংলাদেশ সরকার করে যাচ্ছে কিন্তু মিয়ানমার সরকার অনেক বেশি অনমনীয়। আর তারা বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করার সাহস পাচ্ছে কিছুটা চীনের প্রশ্রয়ে। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত। চীন যদি তাদেরকে চাপ দিত তাহলে মিয়ানমার অগ্রাহ্য করার সাহস পেত না।

রেডিও তেহরান:  মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত বাজেট আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শেরম্যান এক প্রস্তাবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার কথা বলেছেন। এ প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করেছেন শেখ হাসিনা। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শেরম্যান দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলেছেন

সৈয়দ আবুল মকসুদ: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার যে প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শেরম্যান দিয়েছেন-তাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাখ্যানের সাথে পুরোপুরি একমত আমি। কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড ম্যানের মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়েছেন।

রেডিও তেহরান:  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মিয়ানমার যেন তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যায়- কংগ্রেসম্যান শেরম্যানের সেটাই করা উচিত।রোহিঙ্গা ইস্যুতে মার্কিন সরকারের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ: দেখুন, প্রথম দিক থেকে মার্কিন কর্মকর্তারা বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছেন। তারা রোহিঙ্গাদের স্বপক্ষে কথা বলেছেন। রেহিঙ্গাদের প্রতি তাদের সহানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বড় কোনো উদ্যোগ নিতে আমরা দেখি নি। আমি আবারও বলছি রোহিঙ্গা সংকটটি বাংলাদেশের জন্য খুব বড় রকমের সংকট। রোহিঙ্গারা- বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশের ওপর যে বিরুপ প্রভাব ফেলেছে তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এমন বিরুপ ঘটনা বর্তমান পৃথিবীতে খুব কম ঘটেছে। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত থাকা সত্ত্বেও চীন যদি বিষয়টি সমাধানের জন্য আন্তরিকতা দেখাত এবং মিয়ানমার সরকারকে বলত তাহলে বিষয়টি অতি দ্রুত সমাধান হতে পারত।

রেডিও তেহরান: এককথায় যদি বলতে বলা হয়-রোহিঙ্গা সংকটের কি দ্রুত সমাধান সম্ভব ?

অসহায় রোহিঙ্গা শিশু

সৈয়দ আবুল মকসুদ: এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে 'না'। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সরকার অতি মানবিক কাজ করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে অতি মানবিক কাজের ফলশ্রুতিতে যে অতি সংকট তৈরি হয়েছে তার সমাধান এখন তো নাই নিকট ভবিষ্যতে যে হবে এমনটি মনে করি না।    

রেডিও তেহরান:  সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বেশ শক্ত অবস্থানে গিয়ে বলেছেন, “আমেরিকা যেখানে হাত দিয়েছে সেখানেই কিন্তু আগুন জ্বলছে। কোথাও কিন্তু শান্তি আসে নি বরং জঙ্গিবাদ ও অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে।” আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সৈয়দ আবুল মকসুদ: দেখুন, আমেরিকা সম্পর্কে  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কথাগুলো বলেছেন সেটি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটেই বলেছেন বলে আমি মনে করি। যদি আমরা ভিয়েতনামের দিকে তাকাই এবং পৃথিবীর অন্যান্য অস্থির যে অঞ্চলগুলো রয়েছে যেমন –সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন এবং সম্প্রতি ইরানের সাথে আমেরিকার নানা ঘটনা ঘটছে। সেদিকে তাকাই তাহলে দেখব “আমেরিকা যেখানে হাত দিয়েছে সেখানেই কিন্তু আগুন জ্বলছে। কোথাও কিন্তু শান্তি আসে নি বরং জঙ্গিবাদ ও অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেছেন।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৩