ডিসেম্বর ০৮, ২০১৯ ২০:৫৩ Asia/Dhaka

গত আসরে ইমাম হাদি (আ.) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা বলেছি, তৎকালীন আব্বাসীয় স্বৈরশাসক মুতাওয়াক্কিল মাতাল অবস্থায় প্রকাশ্য রাজদরবারে ইমামকে শরাব পানের আমন্ত্রণ জানালে ইমাম ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন।

এরপর ইমাম মুতাওয়াক্কিলকে একটি গল্প শোনান যেখানে ক্ষমতার মোহে অন্ধ রাজা-বাদশাদের করুণ পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। ইমামের এই দৃঢ় অবস্থান আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, আমরা যেন সত্যে অটল থাকতে গিয়ে ক্ষমতাবানদের ভয়ে ভীত না হই। এ ছাড়া, ক্ষণস্থায়ী এই পার্থিব জীবনে আজ আমরা যাদেরকে ক্ষমতাবান দেখছি কাল তাদের পতন অনিবার্য। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরকম অনেক মহাপরাক্রমশালী স্বৈরশাসকের পতনের কথা উল্লেখ করেছেন।

সূরা শুয়ারার ২২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা জুলুম ও নির্যাতনকারী তারা শিগগিরই জানতে পারবে তাদের জন্য কি পরিণতি অপেক্ষা করছে। এ ছাড়া, সূরা আনআমের ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করে দেখো (এবং চিন্তা করো) আমার আয়াত ও ক্ষমতা অস্বীকারকারী ও মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের কি পরিণতি হয়েছে।

ঠিক এ কারণেই নবী বংশের মহান ইমামগণ কখনো ক্ষমতার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি। পাশাপাশি ক্ষমতাধরদের হুমকিকেও তাঁরা সামান্যতম পরোয়া করেননি। তাঁরা কঠোর দমনপীড়নের মধ্যেই নিজেদের ঐশী দায়িত্ব পালন করেছেন এবং শাসকশ্রেণির হুমকিকে সব সময় সুযোগে পরিণত করেছেন। ইমাম হাদি (আ.) উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকদের দরবারি ইসলামের বিপরীতে জনগণের সামনে প্রকৃত ইসলাম তুলে ধরেন। সেইসঙ্গে তিনি বেশ কিছু ছাত্র তৈরি করে যান যারা ইমামের শাহাদাতের পরও খাঁটি মোহাম্মাদি ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

ইমাম হাদি (আ.)’র এরকম একজন ছাত্রের নাম আব্দুল আজিম হাসানি। তাকওয়া ও পরহেজগারিতে এই মহান ইসলামি চিন্তাবিদের কোনো জুড়ি ছিল না। এ সম্পর্কে ইমামের একনিষ্ঠ অনুসারী আবুজামাদ রাজি বলেন, একবার আমি ইমাম হাদি (আ.)’র সান্নিধ্যলাভে ধন্য হই এবং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করি। ইমাম এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাকে বলেন, কখনো কোনো সমস্যা হলে আব্দুল আজিম হাসানির কাছে প্রশ্ন করবে এবং তাকে আমার সালাম পৌঁছে দেবে। প্রখ্যাত শিয়া কবি ও সাহিত্যিক ‘সাহেব বিন ইবাদ’ লিখেছেন: ধর্মীয় ও কুরআনের শিক্ষার ওপর আব্দুল আজিম হাসানির পরিপূর্ণ দখল ছিল।

একবার আব্দুল আজিম হাসানি নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইমাম হাদি (আ.)’র কাছে যান। তিনি একে একে সব ইমামের নাম উল্লেখ করে বলেন, তাদের সবার প্রতি আমার বিশ্বাস রয়েছে। হাসানি আরো বলেন, আমি স্বীকার করছি যে, ইমামদের বন্ধুরা আল্লাহর বন্ধু এবং তাদের শত্রুরা আল্লাহরও শত্রু। তিনি আরো বলেন, আমি বিশ্বাস করি, রাসূলুল্লাহ (সা.)’র মে’রাজ, কবরের সওয়াল-জওয়াব, জান্নাত ও জাহান্নাম, পুলসিরাত এবং মিজান- এসবই সত্য। নিঃসন্দেহে কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং মানুষের ভালোমন্দের বিচার করার জন্য আল্লাহ তায়ালা সেদিন সব মৃত মানুষকে জীবিত করবেন। এসব কথা শোনার পর ইমাম হাদি (আ.) বলেন: আমার রবের শপথ! তুমি সেই ধর্মে ঈমান এনেছো যা মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনিত করেছেন। তুমি তোমার বিশ্বাসে অটল থেকো তাহলে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তোমাকে দ্বীনের পথে সুদৃঢ় রাখবেন।

ইমাম হাদি (আ.)’র আরেকজন প্রখ্যাত ছাত্রের নাম হোসেইন বিন সাঈদ আহওয়াজি। তিনি ইমাম হাদির আগে ইমাম রেজা এবং ইমাম জাওয়াদ আলাইহিমুস সালামেরও সাহচার্য লাভ করেছিলেন। আহওয়াজি এই তিন ইমামের গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষণীয় হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই প্রখ্যাত আলেম ফিকাহ শাস্ত্র ও নৈতিকতা বিষয়ে ৩০টি গ্রন্থ রচনা করেন। মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত আলেম ও মনীষী শেখ তুসি তার সম্পর্কে বলেন: ইসলামি জ্ঞান অর্জনে পাণ্ডিত্য থাকার পাশাপাশি হোসেইন বিন সাঈদ মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার কাজে অগ্রগামী ছিলেন।

গত আসরে আমরা যেমনটি বলেছি, নবী বংশের মহান ইমামগণ মানব জীবনের প্রয়োজনীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল্যবান উপদেশবাণী রেখে গেছেন। ইমাম হাদি (আ.)’রও এরকম অসংখ্য বাণী রয়েছে। তিনি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে তাকে অন্য সবাই ভয় করে এবং যে আল্লাহর আনুগত্য করবে অন্য সবাই তার কথা মেনে চলবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর বান্দেগি করবে তার প্রতি মানুষ কখনো ক্ষুব্ধ হবে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ক্ষুব্ধ করে সে মানুষের ক্রোধের শিকার হবে।

ইমাম হাদি (আ.) একবার রাজদরবারে মুতাওয়াক্কিলের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হন। এ সময় মুতাওয়াক্কিলের এক প্রশ্নের জবাবে ইমাম বলেন, যার প্রতি তুমি বিদ্বেষ পোষণ করো তার কাছ থেকে আন্তরিকতা আশা করো না, যার সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি তুমি ভঙ্গ করেছো তার কাছ থেকে আনুগত্য আশা করো না এবং যার সম্পর্কে তুমি খারাপ ধারণা পোষণ করো, কখনো ভেবো না সে তোমার সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে। কারণ, অপরের সম্পর্কে তুমি যেরকম ধারনা পোষণ করো তাদের অন্তরেও আল্লাহ তোমার সম্পর্কে তেমন ধারনাই সৃষ্টি করে দেন। 

ইমামের এই বক্তব্য যদিও সর্বসাধারণের জন্য একটি উন্মুক্ত উপদেশবাণী ছিল কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি বিশেষভাবে মুতাওক্কিলকে উপদেশ দিয়েছিলেন। ইমাম একথা বলতে চেয়েছিলেন, আমার এবং নবী পরিবারের ওপর চরম বিদ্বেষ পোষণ করে তুমি আমার কাছ থেকে তোমার সম্পর্কে ভালো ধারণা আশা করতে পারো না। সবশেষে ইমাম হাদি (আ.) মানুষকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, সেইদিনের কথা স্মরণ করো যেদিন তুমি তোমার পরিবার, বন্ধুবান্ধবা ও আত্মীয়-স্বজনের চোখের সামনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে কিন্তু কোনো ডাক্তার বা মহৌষধ তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর সময় একমাত্র যে বিষয়টি মানুষকে সাহায্য করতে পারে তা হচ্ছে তার নেক আমল বা সৎকর্মী। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত বা প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে আল্লাহর শাস্তিকে প্রতিহত করা যাবে না। ইমাম এ সম্পর্কে আরো বলেন, দুনিয়া হচ্ছে এমন একটি ব্যবসা ক্ষেত্র যেখানে কেউ কেউ লাভ করে এবং অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পবিত্র কুরআন এই ব্যবসা ক্ষেত্রে তাদেরকেই লাভবান ঘোষণা করেছে যাদের ঈমান আছে এবং যারা সৎকর্ম করে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ