সূরা আস-সাফফাত: আয়াত ৬২-৬৮ (পর্ব-৮)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা আস-সাফফাতের ৬২ থেকে ৬৮ নম্বর আয়াতের তাফসির উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ৬২ ও ৬৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
أَذَلِكَ خَيْرٌ نُزُلًا أَمْ شَجَرَةُ الزَّقُّومِ (62) إِنَّا جَعَلْنَاهَا فِتْنَةً لِلظَّالِمِينَ (63)
“এই (জান্নাত) কি আপ্যায়নের জন্য উত্তম, নাকি যাক্কুম বৃক্ষ?” (৩৭:৬২)
“আমি যালেমদেরকে নির্যাতন ও আজাব দেয়ার জন্য এটি তৈরি করেছি।” (৩৭:৬৩)
এর আগের কয়েকটি আয়াতে জান্নাতের অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে সামান্য কিছু নেয়ামত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর এই দুই আয়াতে জান্নাতের সেই নেয়ামতের সঙ্গে জাহান্নামের কঠিন পরিস্থিতির তুলনা করা হয়েছে। এখানে আমাদের উপলব্ধি করার সুবিধার্তে প্রশ্নের ঢংয়ে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: জান্নাতের নানা রকমের মজাদার খাদ্য ও পানীয় উত্তম নাকি জাহান্নামিদের জন্য যেসব তেতো ও যন্ত্রণাদায়ক খাদ্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে সেগুলো উত্তম?
স্বাভাবিকভাবেই এই দু’টি বিষয় তুলনাযোগ্য নয়। এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি ভালো সেটি প্রশ্ন করে জানারও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মহান আল্লাহ বিষয়টিকে মানুষের জন্য সহজে বোধগম্য করে তোলার জন্য এ প্রশ্নের অবতারণা করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে জাহান্নাম এক মুহূর্তের জন্য স্বস্তিতে বসবাসের কোনো স্থান নয় যে, তার সঙ্গে মহা শান্তি ও স্বস্তির আবাস জান্নাতের তুলনা করা যায়। মূলত পার্থিব জীবনে যারা অন্যায় ও পাপকাজে লিপ্ত হয়ে শান্তি ও সুখের সন্ধান করে তাদের উদ্দেশ করে এখানে বলা হচ্ছে, ক্ষণস্থায়ী জীবনের এই স্বস্তির পরিণতিতে জাহান্নামের মহা আজাব ও অস্বস্তি অপেক্ষা করছে। কাজেই সময় থাকতে তারা যেন সাবধান হয়ে যায়।
এই দুই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- পার্থিব জীবনে আমরা যেসব কাজ করি সেগুলোকে এই দুনিয়ার জীবনের লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় গ্রহণ বা বর্জন করলে হবে না; বরং পরকালে এই কাজের কি পরিণতি হবে সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
২- জাহান্নামে প্রবেশের পূর্বশর্ত জুলুম বা অন্যায়। সে জুলুম হতে পারে নিজের প্রতি, হতে পারে অন্যের প্রতি, হতে পারে ধর্মের প্রতি কিংবা নবী-রাসূল ও আউলিয়াদের প্রতি।
এবারে সূরা সাফফাতের ৬৪ থেকে ৬৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন:
إِنَّهَا شَجَرَةٌ تَخْرُجُ فِي أَصْلِ الْجَحِيمِ (64) طَلْعُهَا كَأَنَّهُ رُءُوسُ الشَّيَاطِينِ (65) فَإِنَّهُمْ لَآَكِلُونَ مِنْهَا فَمَالِئُونَ مِنْهَا الْبُطُونَ (66)
“এটি একটি বৃক্ষ, যা উদগত হয় জাহান্নামের মূলে।” (৩৭:৬৪)
“এর কুঁড়িগুলো শয়তানের মস্তকের মত (কদর্য ও কুৎসিত)।” (৩৭:৬৫)
“জাহান্নামবাসী একে ভক্ষণ করবে এবং এর দ্বারা উদর পূর্ণ করবে।” (৩৭:৬৬)
সূরা সাফফাতের এই আয়াতগুলোতে জাহান্নামের যাক্কুম গাছের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সূরা দুখানের ৪৩ থেকে ৪৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতেও একই ধরনের বর্ণনা রয়েছে। এই দুই সূরার আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, যাক্কুম এমন একটি গাছ বা গুল্ম যার জন্ম হবে জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনের মধ্যে। জাহান্নামবাসী প্রচণ্ড ক্ষুধার তাড়নায় ওই গাছের ফল খেতে বাধ্য হবে। আগুনের মধ্যে যে গাছের জন্ম স্বাভাবিকভাবে সে গাছে কোনো পানি থাকবে না বরং তাতে থাকবে প্রজ্জ্বলনকারী উপাদান। সে গাছের ফল খাওয়ার ফলে জাহান্নামবাসীর ক্ষুধা নিবারণের পরিবর্তে কষ্ট আরো বেড়ে যাবে।
এই গাছের লতা ও গুল্ম অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত ও তেতো হওয়ার পাশাপাশি দেখতে শয়তানের মস্তকের মতো ভয়ঙ্কর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অতীতকাল থেকে আরব উপত্যকার লোকজন শয়তানের মস্তককে ভয়ঙ্কর বলে ধারনা করে এসেছে। সেইসঙ্গে তারা ফেরেশতাদেরকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় বলে মনে করত; যদিও কেউ কোনোদিন শয়তান বা ফেরেশতা কাউকেই দেখতে পায়নি।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- পার্থিব বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে পরকালের পরিচালনা পদ্ধতির পার্থক্য রয়েছে। কাজেই পরকালে জাহান্নামের ভয়ঙ্কর আগুনের মধ্যে গাছ জন্মানো অসম্ভব কোনো ব্যাপার হবে না বরং এটা যে অকাট্য সত্য সেকথা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মজিদের মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন।
২- যারা পার্থিব জীবনে শয়তানের কথায় জীবন পরিচালনা করে তাদের জন্য পরকালে এমন গাছ ও লতাগুল্ম অপেক্ষা করছে যেগুলো দুনিয়ার গাছের মতো সবুজ ও মনোরম নয়; বরং দেখতে কুৎসিত। মনে হবে যেন, শয়তানের মস্তক মাটি ফেটে বেরিয়ে এসেছে।
সূরা সাফফাতের ৬৭ ও ৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
ثُمَّ إِنَّ لَهُمْ عَلَيْهَا لَشَوْبًا مِنْ حَمِيمٍ (67) ثُمَّ إِنَّ مَرْجِعَهُمْ لَإِلَى الْجَحِيمِ (68)
“তদুপরি তাদেরকে (ওই খাদ্যের ওপর) দেয়া হবে ফুটন্ত টগবগে পানির মিশ্রণ।” (৩৭:৬৭)
“অতঃপর তাদের প্রত্যাবর্তন হবে জাহান্নামের দিকে।” (৩৭:৬৮)
স্বাভাবিকভাবেই যাক্কুম গাছের ফল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাহান্নামবাসীর প্রচণ্ড পানির পীপাসা লাগবে। এই দুই আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে: যারা যাক্কুম গাছের ফল খাবে তারা তাদের পীপাসা নিবারণের জন্য এমন পানি পান করবে যা টগবগে ফুটন্ত ও দুষিত। এই পানি পীপাসা নিবারণের পরিবর্তে পীপাসাকে আরো বাড়িয়ে দেবে। পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: জাহান্নামবাসী যাক্কুম গাছের ফল ও এই ফুটন্ত পানি খাওয়ার পর জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অর্থাৎ তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশের আগেই যাক্কুম গাছের ফল খাওয়ানো হবে এবং এই ফল ও ফুটন্ত পানি দিয়েই তাদেরকে জাহান্নামে অভ্যর্থনা জানানো হবে। যদি জাহান্নামে প্রবেশের আগেই এই শাস্তি দেয়া হয় তাহলে সেখানে প্রবেশের পর গুনাহগার বান্দাদের জন্য কি কঠিন আজাব অপেক্ষা করছে তা সহজেই অনুমেয়।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- জান্নাতবাসীর মতো জাহান্নামবাসীকেও খেতে এবং পান করতে দেয়া হবে। তবে জাহান্নামবাসীর খাবার যেমন মজাদার ও তৃপ্তিদায়ক নয় তেমনি তা দেখতে ভয়ঙ্কর এবং তা খাওয়া হবে চরম অস্বস্তিকর ও পীড়াদায়ক।
২- যারা পার্থিব জীবনে হারাম খাবার দিয়ে উদরপূর্তি করে এবং আল্লাহর দেয়া হারাল-হারামের বিধান মেনে চলে না পরকালে তাদেরকে এমন সব খাবার খেতে দেয়া হবে যা হবে চরম আজাবের শামিল।
৩- কিয়ামতের দিন বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে জান্নাত ও জাহান্নামবাসী নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাবে। জান্নাতবাসীর জন্য যেসব পর্যায় রাখা হয়েছে তার প্রত্যেকটি অতিক্রম করার সময় তারা চরম স্বস্তি ও শান্তিলাভ করবে। অন্যদিকে জাহান্নামবাসীর জন্য প্রত্যেকটি ধাপ হয়ে চরম অস্বস্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক।#