জীবনশৈলী (পর্ব-২৪): ধৈর্য্য ও সহনশীলতা
গত আসরে আমরা বলেছি ভালো ও সুন্দর কথা এবং নম্র আচরণ মানুষের এক অমূল্য সম্পদ। জীবনকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সুন্দর কথা ও আচরণের বিকল্প নেই।
ভালো কথার মাধ্যমে একজন ক্ষুব্ধ ব্যক্তিকেও স্থির ও শান্ত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সাধারণত অন্যের রাগ, ক্ষোভ, গালমন্দ ও অপমানের মোকাবেলায় নীরবতা ভালো ফল দেয়। পাশাপাশি ঝগড়া না করে ক্ষুব্ধ ব্যক্তির সঙ্গে সদাচারণ করার অর্থ হলো, মন্দ মানুষকেও ভালো আচরণের শিক্ষা দেওয়া। সাধারণত এ ধরণের পরিস্থিতিতে মন্দ আচরণের মানুষের মধ্যেও পরিবর্তন আসে এবং ভালো ব্যবহার করতে শেখে। মানুষের কথা ও বক্তব্য হচ্ছে তার ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। ভদ্র মানুষ সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও বকাঝকা করেন না। আজকের আসরে আমরা ধৈর্য্য ও সহনশীলতা নিয়ে আলোচনা করব।
মানব জীবনকে কেউ কেউ সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। সমুদ্রে কখনো বয়ে যায় উত্তাল ঢেউ, আবার কখনো পরম নিরবতা। মানব জীবনও কখনোই এক অবস্থায় থাকে না। আমাদের জীবনেও রয়েয়ে নানা চড়াই-উৎড়াই। জীবনে সুখ যেমন আছে, তেমনি দুঃখও আছে। এ এক অনিবার্য বাস্তবতা। এ কারণে দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হলে যেমন হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া উচিত নয় তেমনি সুখের সময়ও তাতে ডুবে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নায়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের জীবনে নানা চড়াই-উৎড়াই দিয়েছেন যাতে আমরা বুঝতে পারি প্রকৃত শক্তি ও ক্ষমতা আমাদের হাতে নয়, আল্লাহই সর্বশক্তিমান, তিনিই পরম ক্ষমতার অধিকারী। আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ চান মানুষের জীবনপ্রণালী ও ইবাদত-বন্দেগি হবে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টির পরিচায়ক। এ কারণে আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলেছেন, মানুষকে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং আমার ওপর নির্ভর করতে হবে তাহলেই আমি তাদের সাহায্য করব। এছাড়া মহান আল্লাহ মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম হওয়ার বাসনা লালন করতে বলেছেন। এর ফলে আল্লাহ মানুষকে সর্বোত্তম প্রতিদান দেবেন।
কেউ যখন মন থেকে ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা চালায় এবং জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে চায় তখন তার জন্য আল্লাহর রহমতের দরজা খুলে যায়। জীবন আরও রঙিন ও আরও সুন্দর হতে থাকে। আর এ ক্ষেত্রে সদাচার হচ্ছে মানুষের এমন একটি গুন যা সদাচারীর প্রতি মানুষের আকর্ষণ যেমন বাড়িয়ে তুলে তেমনি আল্লাহর রহমত ও বরকতের পথকে প্রশস্থ করে। অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যকে একসঙ্গে সদাচার বলা যেতে পারে। এসব বৈশিষ্ট্যের একটি হলো ধৈর্য্য ও সহনশীলতা। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) বলেছেন, আমার আল্লাহ মানুষের প্রতি ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। এই বার্তা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে হজরত জিব্রাইল (আ.) মহানবী (স.)'র কাছে এসে বললেন, হে মোহাম্মাদ, আপনার আল্লাহ আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং আপনার প্রতি বার্তা হচ্ছে তার সৃষ্টির প্রতি সহশনীলতা প্রদর্শন করুন।
সহনশীলতা হচ্ছে অন্যের সঙ্গে নম্র ও ভালো আচরণ করা এবং সহিংসতা পরিহার করা। জন্মগতভাবেই মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মানুষ সচেতনভাবে এই বৈশিষ্ট্যকে নিজের মধ্যে আরও জোরালো করতে পারে। আহলে বাইতের সদস্য ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজে নম্র। তিনি নম্রতা পছন্দ করেন। আল্লাহ নম্রতার জন্য যে পুরস্কার দেন, হিংস্রতা ও কঠোরতার জন্য সে পুরস্কর দেন না। আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.) অন্যের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শনের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন, ঈমানের পর বিবেকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সহনশীলতা। তার মতে, সহনশীলতা হচ্ছে জ্ঞান-প্রজ্ঞার ফল। সামাজিক জীবনে বিশেষকরে পরিবারে এই বৈশিষ্ট্যের ব্যাপক গঠনমূলক প্রভাব রয়েছে। পরিবার থেকেই সহনশীলতার চর্চা শুরু করা জরুরি।
আসলে বাহ্যিকভাবে মানুষের মধ্যে যেমন নানা অমিল রয়েছে তেমনি চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। এ কারণে মানুষের একে অপরের মধ্যে মতভেদ হতেই পারে। এ অবস্থায় অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি ও তা বজায় রাখার জন্য আমাদের সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো সহনশীলতা। সহনশীলতা মানে অন্যের চিন্তা-ভাবনা, রীতি-নীতি, চলাফেরা, ধারণা ও সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে শেখা। পৃথিবীতে কোনো একটা কাজ কিংবা কোনো একটা সমস্যার সামধান বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে এমনকি জীবন সম্পর্কেও মানুষের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্যের মতামতকে মর্যাদা দিতে পারা, সেটা শোনা এবং মেনে নিতে পারাই হলো সহনশীলতা। সহনশীলতার আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো ধৈর্য ধরে অন্যের আচার-আচরণ ও চালচলন-গতিবিধিকে মূল্যায়ন করা, হুট করে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ না নেয়া। হতে পারে আমার প্রতিবেশী যা করছে সেটা যথেষ্ট অযৌক্তিক এবং তার আচার-আচরণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, কিন্তু তাই বলে বিরক্তি ও একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তার উপর ঝাপিয়ে পড়লে চলবে না। ওই ব্যক্তির কর্মকাণ্ডকে সংশোধন করতে চাইলে তাকে সুন্দর করে বুঝাতে চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রেও সহনশীলতা জরুরি।
অন্যের ভালো লাগা, খারাপ লাগা, অন্যের মতামত ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখালে সমাজে বিশৃঙ্খলা-অশান্তিই শুধু বাড়বে। কারো আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ পছন্দ না হলে তাকে বুঝিয়ে বলা যেতে পারে, নম্র-ভদ্রভাবে যুক্তি উপস্থাপন করা যেতে পারে। সহিংস হওয়া যাবে না। ধৈর্য্য ও সহনশীলতা না থাকলে এটা করা সম্ভব নয়। সহনশীলতা হলো সুখী হওয়ার অন্যতম প্রধান উপায়। বর্তমানে আমাদেরকে সমাজে অনেকে সামান্য কারণে একে অন্যের সাথে অসহনশীল আচরণ করছে। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে ঝগড়া-বিবাদ, অশান্তি এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো নারকীয় ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। ইসলাম কখনো এমন অসহনশীল আচরণের শিক্ষা দেয় না। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সহনশীলতার গুণে নিজেদেরকে গুণান্বিত করা। আর এ গুণ অর্জিত হবে অন্যকে ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ার মাধ্যমে। স্মরণ রাখবেন, যে মানুষকে ক্ষমা করে, কেয়ামতের সেই কঠিন বিচারের দিন আল্লাহ্তায়ালাও তাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করবেন।
বন্ধুরা, আমরা সবাই সুন্দর, অর্থপূর্ণ ও শিক্ষণীয় কথা বলার চেষ্টা করব-এ প্রত্যাশায় শেষ করছি জীবনশৈলীর আজকের আসর। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১