সোনালী নীড় (৬ষ্ঠ পর্ব)
আসলাম সাহেব বাসায় ফিরে দেখলেন তার স্ত্রী ঘরে নেই। ক্লান্তিকর কাজ শেষে ঘরে ফিরে স্ত্রীকে না দেখা আসলাম সাহেব কেন, সকল স্বামীর পক্ষেই কষ্টকর একটা ব্যাপার।
কিন্তু তারচেয়েও কষ্টকর হলো স্ত্রী কোথায় গেল-এটা জানা না থাকা। আসলাম সাহেব সোফায় বসে ভাবছেন, এমন সময় একটা ফোন এলো- আসলাম সাহেব হ্যালো বলতেই ফোনটা কেটে গেল। স্বাভাবিকভাবেই মাথায় আরেকটা দুশ্চিন্তা ঢোকার কথা। আসলাম সাহেব পায়চারী করতে করতে স্ত্রীর ড্রেসিং টেবিলের ওপর চিঠির প্যাড খোলা দেখতে পেলেন। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা সন্দেহজনক বৈ কি। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে যদি তার স্ত্রী ঘরে এসেই পড়তো তাহলে আসলাম সাহেবের কী করণীয় ছিল? কোথায় গেছ? কেন গেছ? কেন আমাকে আগে জানাওনি? চিঠির প্যাড এখানে কেন? কার কাছে গোপনে গোপনে চিঠি লেখ ?-এসব করা কি সঙ্গত ? না, মোটেই না। কারণ এটা সন্দেহপ্রবণ মনের অভিব্যক্তি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রবিত্র কোরআনে বলেছেন, হে ঈমানদারগণ, অধিকাংশ অমূলক ধারণা করা পরিহার কর, কেন না আন্দাজ অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে নিশ্চিতরূপে গুনাহের কাজ হিসেবে পরিগণিত। তাছাড়া ইসলাম সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য না পাওয়া পর্যন্ত সন্দেহ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, সন্দেহ করার ব্যাপারে সতর্ক হও, কেননা সন্দেহ ইবাদত ধ্বংস করে এবং গুনাহ বৃদ্ধি করে।
ফলে সন্দেহ করা যাবে না। সন্দেহ পোষণ করলে স্ত্রীর বিশ্বস্ততাকে অবিশ্বাস করা হয়। এ ধরণের সন্দেহপরায়নতা পারিবারিক জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। এ রকম মানসিকতায় যারা ভোগেন তারা সারাক্ষণ স্ত্রীকে গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করতে থাকেন। কিছু একটা হলেই সন্দেহের স্বপক্ষে প্রমাণ দেখতে পান। তার কাজই হয়ে পড়ে কেবল স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করা। অথচ ধৈর্যের সাথে সন্দেহ মুক্ত মন নিয়ে স্ত্রীকে দেখলে এক সময় স্ত্রী নিজেই হয়তো আপনাকে জানাবে কোথায় গেছে, কি করেছে, কার কাছে চিঠি লিখেছে। ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে স্বামী নিজেই এক সময় তার স্ত্রীকে বলেছিল-বাড়ীতে একটা চিঠি লিখতে। সেই চিঠিটাই লিখেছিল তার স্ত্রী। আর পোস্ট করার জন্যে গিয়েছিল পোস্ট অফিসে। কিন্তু পোস্ট অফিসে যথারীতি ভীড় থাকায় বাসায় ফিরতে তার দেরী হয়ে যাচ্ছিল। সেজন্যে টেলিফোন করে স্বামীকে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বাসার টেলিফোন সেটে সমস্যা থাকায় রিং হওয়ার পর কেটে যাচ্ছিল। যার ফলে আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। এই সত্যটি যতোক্ষণ না অপনি জানছেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত আপনার মন থেকে সন্দেহের কালিমা দূর হচ্ছে না। কিন্তু কথা হলো স্ত্রীকে সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিলে স্ত্রী কি আপনাকে এই তথ্যটি মজা করে জানাতে যাবে ? অতএব সন্দেহ পরায়ন হওয়াটা মোটেই কল্যাণের নয় বরং হাসিখুশী থাকুন, স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত হন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, "যদি কেউ স্ত্রীর নামে দুঃশ্চরিত্রের মিথ্যা অপবাদ দেয়, তাহলে তার সমস্ত ভালকাজের সুফল বাতিল হয়ে যাবে। যেমন সাপের গা থেকে তার খোলস ঝড়ে পড়ে।" নবীজী আরো বলেছেন, যে কেউ ঈমানদার নারী বা পুরুষের নামে মিথ্যা অভিযোগ করে, শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ তাকে জ্বলন্ত অগ্নিকান্ডের ওপর বসিয়ে দেবেন, যেন সে এই অপরাধের যোগ্য শাস্তি পায়।"
ফলে অমূলক সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকুন। তারমানে এই নয় যে, আপনি স্ত্রীর আচরণের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসিন থাকবেন। বরং আপনার দেখা আলামতটাকে আপনি নিজেই যাচাই করুন-স্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্যে নয় বরং সত্যটাকে জানার জন্যে। সত্য না জেনেই কোন রকম সিদ্ধান্ত নেয়া, বাড়াবাড়ি করা মারাত্মক ভুল। যে ঘটনাটি আমরা আলোচনার শুরুতে জানলাম, সেখানে সন্দেহবশত স্ত্রীকে পরকীয়ার অভিযোগে যদি অভিযুক্ত করতেন, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো? না, সেটি মোটেই ভালো হতো না। স্ত্রী অপমানিত বোধ করতো। নিজস্ব সম্মান ও ব্যক্তিত্ব হারানোর যন্ত্রণায় স্ত্রী অবশ্যই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতেন। অথচ স্ত্রী মোটেই কোন অন্যায় করেননি। শুধুমাত্র ছোট্ট একটি অবিশ্বাস একটি সুন্দর সংসারকে ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দেয়ার আশঙ্কা থেকে যেত। স্বামীর অমূলক সন্দেহের ব্যাপারটা যদি বাইরে জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে আরো বড়ো বিপদ হতে পারে। মানুষ মাত্রই শত্রুমিত্র পরিবেষ্টিত থাকে। আপনার শত্রুরা এই সন্দেহের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আপনার সংসারের ব্যাপারে নাক গলাবার সুযোগ পাবে। তারা আপনার সন্দেহকে যথার্থ বলে প্রমাণ করার কুমতলবে বিভিন্ন গালগল্প ও বানোয়াট ঘটনার জন্ম দেবে। যা আপনার কাছে সত্য বলে মনে হবে। আপনি যখন সে সবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা মহা বিপদে পড়বেন-তখন তারা দেখে দেখে উপহাসের হাসি হাসবে।
মনে রাখবেন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালবাসার সম্পর্ক। এখানে তাই গভীর আবেগ ও আন্তরিকতা কাজ করে। কোন রকম সন্দেহ-অবিশ্বাস ভালবাসা বা আন্তরিকতাকে নষ্ট করে দেয়। সহজ-সরল পবিত্র মনে যদি একবার সন্দেহের কালো দাগ পড়ে, ঐ দাগ চিরজীবন থেকে যাবে। তাই যেকোন কাজ চিন্তা-ভাবনা করে করুন। হুট করে কোন কাজ করে বসা মারাত্মক ভুল, যেমনটি কবিও বলেছেন-
একটু খানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে
ভুল করেছে যারা সবাই ভুক্তভোগী বটে।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, তাহলো স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সন্দেহপরায়নতার যদি কোন কারণই না থাকে, অর্থাৎ স্ত্রী যদি সত্যিই সন্দেহজনক কোন কাজ না করে থাকে, তাহলে স্বামীর সন্দেহপ্রবণতা একটা মানসিক রোগ বৈ কি! এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর কিছু করণীয় থেকে যায়। প্রথমতঃ আপনাকে গভীর মনোযোগ ও আন্তরিকতা দিয়ে দেখতে হবে, আপনার স্বামী আপনার ঠিক কোন আচরণটিকে সন্দেহজনক ভাবছে। যদি আবিস্কার করছে সক্ষম হন, তাহলে ঐ ধরণের কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। আপনি এমনটি ভাববেন না যে আপনি আপনার স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাস হয়ে পড়েছেন। বরং একজন স্ত্রী হিসেবে আপনার মানসিকভাবে অসুস্থ স্বামীর প্রতি এটি আপনার দায়িত্ব। আপনি আপনার ভালবাসা দিয়ে সেবা-যত্ন দিয়ে স্বামীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করুন।
এভাবে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালবাসার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার সমস্যাগুলো সমাধান করা চেষ্টা করুন। একটি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল পরিবার গঠনের স্বার্থে এ ধরণের আত্মত্যাগের কোন বিকল্প নেই। হযরত আলী (আঃ) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করবো। তিনি বলেছেন, যে অন্যের দুর্বলতার অনুসন্ধান করে, তাকে প্রথমে নিজের দিকে তাকাতে হবে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবুসাঈদ/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।