সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২০ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান। গত আসরে আমরা ইরানের নামকরা প্রদেশ ইস্ফাহানের কেন্দ্রিয় শহর ইস্ফাহানের নাকশে জাহান বা ইমাম স্কোয়ারে গিয়েছিলাম।

ইস্ফাহানকে বলা হয় 'নেসফে জাহান' মানে অর্ধ বিশ্ব। আবার ইস্ফাহান শহরকে বলা হয় ‘মোজে হামিশে জেন্দেয়ে ইরান’। এর অর্থ হলো অমর যাদুঘর। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে এই শহরে রয়েছে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন এবং প্রাণবন্ত ও মনোরম দৃশ্যাবলি।

আমরা বলেছি নাকশে জাহান স্কোয়ারের চারপাশে চারটি বাজার আছে। এসব মার্কেট এমনভাবে বানানো হয়েছে যে যে কেউ চাইলে এইসব দোকানের ভেতর দিয়ে স্কোয়ারে প্রবেশ করতে পারবে। এখানকার ঐতিহাসিক স্থাপনা যেমন শেখ লুৎফুল্লাহ মসজিদ, কায়সারিয়া ফটক বা প্রধান প্রবেশ দ্বার, ওস্তাদ আলি রেজা আব্বাসির সোলস লিপিকর্মের কারুকাজে সুসজ্জিত ক্যালিগ্রাফিগুলোর কথা বলেছি। সাফাভি শাসনামলে এই শিল্পী ব্যাপক খ্যাতিমান ছিলেন। নাকশে জাহান বা ইমাম স্কোয়ারের একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন এই কায়সারিয়া ফটক বা প্রধান দ্বার। আজকের আসরে আমরা এই নাকশে জাহান ছেড়ে চহরবাগ নামে বিখ্যাত সবুজে ঘেরা সড়কের দিকে যাবো। ইস্ফাহানের ইতিহাসের প্রাণ এই সড়কটি। ইস্ফাহান ভ্রমণ করতে যারা যাবেন তারা অবশ্যই এখানে যেতে ভুলবেন না। এই সড়কটি পর্যটনের পাশাপাশি বাণিজ্যেরও মূল কেন্দ্র।

চহরবাগ আব্বাসি সড়ক শাহ আব্বাসের শাসনের সময় নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে এক হাজার হিজরি মোতাবেক পণের শ একানব্বুই খ্রিষ্টাব্দ। চহরবাগ আব্বাসি সড়কটি আজও আছে। দুই ভাগে এর পরিচিতি কিংবা বলা যায় বিস্তৃতি ঘটেছে। একটি অংশকে চহরবাগ উর্ধ্ব আরেক অংশ চহরবাগ নিম্ম নামে পরিচিত। তবে পুরো সড়কটি চহরবাগ নামেই বিখ্যাত। এই সড়কটির উপরের অংশ সিওসে পোলের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই সড়কটির কয়েকটি পৃথক পৃথক লাইন রয়েছে। কোনো লাইনে গাড়ি চলে, কোনো লাইনে বাইসাইকেল এবং অপর অংশে পথচারী। চারটি লেনের মাঝখানে গাছ-গাছালিতে পূর্ণ। যার ফলে প্রতিটি লেনই আলাদা হয়ে গেছে। সুতরাং সবুজ শ্যামল গাছ-গাছালিতে ঘেরা এই সড়কের পথচারী অংশে পায়চারী করার স্মৃতি কেউ ভুলবে না।

এই যে গাছ গাছালির কথা বললাম এগুলো বিখ্যাত চেনর গাছ এবং নরুন গাছ। এসব গাছের ছায়ায় পায়চারী করার আনন্দই আলাদা। মজার ব্যাপার হলো এই ছায়াময় পথে পায়চারী করতে করতে পাশের দোকানগুলো দেখতে পাওয়া যাবে। জামাকাপড়, জুতা, ব্যাগ কিংবা বিচিত্র হস্তশিল্প যে-কোনো পথচারীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করবে নি:সন্দেহে। চহরবাগ আব্বাসি সড়কের শুরু থেকে পায়চারী করলে প্রথমেই দারওয়াজে দৌলাতে গিয়ে পৌঁছবেন। এখানেই রয়েছে প্রাসাদ এবং হাশত বেহেশত বাগান। হাশত বেহেশত ছাড়াও চহরবাগ সড়কের পাশে আরও বহু প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় অন্যান্য প্রাসাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু এই হাশত বেহেশত বাগিচাই আজও তার ঐশ্বর্য ধরে রেখেছে।

আমরা চহরবাগ সড়কের পাশের বিখ্যাত প্রাসাদ হাশত বেহেশতের কথা বলছিলাম। বিশ্বখ্যাত এই প্রসাদটির সৌন্দর্য এতো আকর্ষণীয় ছিল যে পৃথিবীর সৌন্দর্যতম প্রাসাদ বলেও অভিহিত করা হতো। বুলবুল বাগিচার কাছে শাহ সোলায়মান সাফাভির শাসনামলে এক হাজার আশি হিজরিতে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল।  দোতলা এই ভবনটি তার স্থাপত্যশৈলীর অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে যেমন দর্শকনন্দিত তেমনি সাফাভি শাসনামলের স্থাপত্যের সৌন্দর্যও এই ভবনটিতে লক্ষ্য করা যায় বলে সর্বজন সমাদৃতি পেয়েছে প্রাসাদটি। যারাই এই ইস্ফাহান প্রদেশে বেড়াতে আসেন, দেশি কিংবা বিদেশি সকল পর্যটকই মোটামুটি এই হাশত বেহেশত না দেখে যান না। তাদের মধ্যে যারা প্রাসাদের ভেতরে যাবার সুযোগ পেয়েছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে হাশত বেহেশত প্রাসাদ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রাসাদ স্থাপনা।

বন্ধুরা! ইস্ফাহান ভ্রমণের এ পর্যায়ে চলুন হাশত বেহেশতের কাছেই আরেকটি প্রাচীন স্থাপনার দিকে যাওয়া যাক। এটি একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থাপনা। নাম হলো চহরবাগ মাদ্রাসা। বর্তমানে এই মাদ্রাসাটি ইমাম সাদিক ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামেই বেশি পরিচিত। ফার্সিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মাদ্রাসা বলে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। এগারো শ চার থেকে এগারো শ ছাব্বিশ-এই সময়সীমার মধ্যে শাহ সুলতান হোসাইন সাফাভির শাসনামলে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। এটিই সাফাভি শাসনামলের সর্বশেষ স্থাপনা। ইরানি শিল্পীদের শিল্পবোধ ও শৈলিগত দক্ষতারও প্রমাণ বহন করছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থাপত্যশৈলী। এর স্থাপত্য কাঠামোটি ইস্ফাহানি স্টাইলের। চহরবাগ মাদ্রাসার গম্বুজের সৌন্দর্য এবং কাঠামো তুলনামূলকভাবে শেখ লুৎফুল্লা মসজিদের মতোই।)

বিরতির আগে চহরবাগ মাদ্রাসার গম্বুজের সৌন্দর্য এবং কাঠামোর তুলনামূলক সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলছিলাম। শিল্প ও স্থাপত্যকলায় বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন চরহরবাগ মাদ্রাসা স্থাপনাটিতে সোনা রুপার কারুকাজসহ সূক্ষ্ম আরও যেসব কারুকাজ করা হয়েছে সেগুলো সত্যিই নজিরবিহীন। টাইলসের কারুকাজের দিক থেকেও এই মাদ্রাসা স্থাপনার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এতো বিচিত্র টাইলসের কাজ রয়েছে এই ভবনটিতে যে বলা হয়ে থাকে এটি তো মাদ্রাসা নয়ে যেন ইস্ফাহানের টাইলস শিল্প যাদুঘর। মাদ্রাসার একটি বড়সড়ো আঙিনা রয়েছে। মাদ্রাসার চারপাশ জুড়ে রয়েছে বিশাল বিশাল সবুজ গাছগাছালি। আঙিনার মাঝখানে রয়েছে বহমান ফোয়ারা। উঠোনের চারপাশে রয়েছে অসংখ্য হুজরা মানে কক্ষ। সব মিলিয়ে এখানকার পরিবেশ অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। এই পরিবেশে একবার গেলে সহজেই চলে আসতে মন চাইবে না। তাই বলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর চলবে না। চহরবাগ মাদ্রাসার আশেপাশে যেসব ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে সেগুলোও তো দেখতে হবে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ