সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

গত আসরে আমরা ইরানের নামকরা প্রদেশ ইস্ফাহানের কেন্দ্রিয় শহর ইস্ফাহানের নাকশে জাহান বা ইমাম স্কোয়ারে গিয়েছিলাম। ইস্ফাহানকে বলা হয় 'নেসফে জাহান' মানে অর্ধ বিশ্ব। আবার ইস্ফাহান শহরকে বলা হয় ‘মোজে হামিশে জেন্দেয়ে ইরান’। এর অর্থ হলো অমর যাদুঘর। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে এই শহরে রয়েছে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন এবং প্রাণবন্ত ও মনোরম দৃশ্যাবলি।

গত আসরে আমরা চরহরবাগ মাদ্রাসা এবং এই মাদ্রাসা স্থাপনাটির সোনা রুপার কারুকাজসহ নজিরবিহীন সূক্ষ্ম আরও যেসব কারুকাজ রয়েছে সেসব নিয়ে কথা বলেছিলাম । টাইলসের কারুকাজের দিক থেকেও এই মাদ্রাসা স্থাপনার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এতো বিচিত্র টাইলসের কাজ রয়েছে এই ভবনটিতে যে বলা হয়ে থাকে এটি তো মাদ্রাসা নয়ে যেন ইস্ফাহানের টাইলস শিল্প যাদুঘর। মাদ্রাসার একটি বড়সড়ো আঙিনা রয়েছে। মাদ্রাসার চারপাশ জুড়ে রয়েছে বিশাল বিশাল সবুজ গাছগাছালি। আঙিনার মাঝখানে রয়েছে বহমান ফোয়ারা। উঠোনের চারপাশে রয়েছে অসংখ্য হুজরা মানে কক্ষ। সব মিলিয়ে এখানকার পরিবেশ অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। বলেছিলাম যে এই পরিবেশে একবার গেলে সহজেই চলে আসতে মন চাইবে না। তাই বলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর চলবে না। চহরবাগ মাদ্রাসার আশেপাশে যেসব ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে সেগুলোও তো দেখতে হবে।

ইস্ফাহানের প্রাণবন্ত চল্লিশ পিলার বা চেহেল সুতুন প্রাসাদ

চহরবাগ মাদ্রাসার উত্তরদিকে বেশ উঁচু একটি বাজার রয়েছে খুবই সুন্দর। সাফাভি শাসনামলে উঁচু এই বাজারটিকে শাহী বাজার নামেও অভিহিত করা হতো। আজকাল অবশ্য এই বাজার শিল্পকর্মের বাজার হিসেবেই বিখ্যাত। বাজারের ভেতরের যে পরিবেশ তা এককথায় অসাধারণ। সাফাভি শাসনামলের স্থাপত্য নিদর্শনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলা যায় এই বাজারটিকে। সোনা-রুপার চোখ ধাঁধানো শিল্পকর্মে অন্যরকম ঐশ্বর্য লাভ করেছে এই শিল্প বাজার। ইস্ফাহানের স্থানীয় শিল্পীরাই এইসব অনন্য সাধারণ কারুকাজগুলো করেছে। আর এইসব চিত্তাকর্ষক কারুকাজের কারণে শিল্পবাজারটিকে ভ্রমণকারীদের কাছে ইস্ফাহানের বাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছে                                                                                           

চহরবাগ মাদ্রাসার পূর্বদিকে একটি সরাইখানা রয়েছে। ‘মাদার শাহ’ অর্থাৎ শাহের মা নামে প্রতিষ্ঠিত এই সরাইখানাটিকে বর্তমানে আব্বাসি সরাইখানা নামেই চেনে সবাই। বিগত তিন শতাব্দি মানে তিন শ বছর ধরে ভ্রমণকারীদের কাছে সবচেয়ে প্রশান্তিদায়ক এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশের জন্য এই মাদার শাহ সরাইখানাই ছিল বিখ্যাত এবং এখনও এর গ্রহণযোগ্যতা আগের মতোই আছে। বিশ্বব্যাপী আধুনিক হোটেলের স্থাপত্যশৈলী বলতে যা বোঝায় সেই বিচারে এই আব্বাসি সরাইখানা এখনও প্রথম স্থানীয় হিসেবে স্বীকৃত। এরকমই অনন্য এবং নজিরবিহীন একটি আবাসিক স্থাপনা এই মাদার শাহ সরাইখানা। এখন তো আর সরাইখানা বলা হয় না, এখন আবাসিক হোটেল বলেই জানে সবাই। আপনারা যদি কখনও ইস্ফাহান সফরের সুযোগ পান অবশ্যই ঐতিহাসিক এই হোটেল স্থাপনাটি দেখে আসতে ভুলবেন না। ভুলবেন না এখানকার অন্যরকম আতিথেয়তা বরণের সৌভাগ্য ও অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ নিতে।

শাহ আব্বাসি হোটেল ছেড়ে চহরবাগ সড়ক ধরে হাঁটতে থাকলে ইস্ফাহানের আরও একটি ঐতিহাসিক স্থাপনার মুখোমুখি হবো আমরা। এই স্থাপনাটি সাফাভি শাসনামলের সুন্দর সুন্দর প্রাসাদগুলোর একটি। প্রাসাদটির নাম হলো চেহেল সুতুন। ফার্সিতে চেহেল মানে চল্লিশ আর সুতুন মানে পিলার। সুন্দর এই প্রাসাদটি ছিল সাফাভি শাসকদের রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা। বহির্বিশ্বের কোনো দেশের রাজা-বাদশা কিংবা কোনো রাষ্ট্রদূত এলে এই প্রাসাদে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হতো। বহিরাঙ্গিক সৌন্দর্যময় অসাধারণ এই প্রাসাদ ভবন হিজরি এগারো শতকের অন্যতম একটি স্থাপত্য নিদর্শন।

ইস্ফাহানের প্রাণবন্ত চল্লিশ পিলার বা চেহেল সুতুন প্রাসাদ

মজার একটি ব্যাপার হলো চল্লিশ পিলার বা চেহেল সুতুন নামে পরিচিত এই প্রাসাদে কিন্তু চল্লিশটি পিলার নেই। তাহলে এরকম নামকরণ কেন? প্রশ্ন জাগতেই পারে। এই প্রাসাদের আসলে পিলার হলো বিশটি। তবে প্রাসাদের সামনের আঙ্গিনায় বড়ো একটি হাউজ আছে। পানিভর্তি ওই হাউজে বিশটি পিলারের প্রতিকৃতি আয়নার মতো জ্বলজ্বলে দেখা যায়। শোভাবর্ধনকারী ওই প্রতিকৃতির পিলারের সংখ্যা হিসেব করেই চল্লিশ বা চেহেল সুতুন নামকরণ করা হয়েছে। সবুজ বাগ বাগিচায় ঘেরা নির্মল পরিবেশে নির্মিত এই প্রাসাদে বসবাস যে কতোটা আরামদায়ক হবে তা তো ভাবতেই অনুমান করা যায়। আজকাল রাতের বেলায় বিচিত্র আলোর ঝলকানিতে হৃদয় কেড়ে নেওয়া সৌন্দর্যে ভরা প্রাসাদের চারপাশের উদ্যানের পরিবেশ যে কাউকেই প্রাসাদ ছেড়ে বাইরের দিকে টানবে। যারা কবিতা লেখেন কিংবা কবিতা উপভোগ করেন তাদের মুখে রাতের নিয়ন আলোয় দুচারটে পংক্তি আনমনেই উচ্চারিত হতে পারে এই উদ্যানে।

ইস্ফাহানে আসলে দেখার আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে এখানে আছে যয়ান্দেরুদ নামে একটি নদী। ওই নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে অসংখ্য সেতু। বিভিন্ন নামে পরিচিত এইসব সেতুর সৌন্দর্যই অন্যরকম। ঐতিহাসিক এইসব সেতু না দেখলে আপনাদের ইস্ফাহান সফরই বৃথা হয়ে যেতে পারে। প্রাচীনকালে নদীর দুই পাশে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে যোগাযোগের সুবিধার্থে অর্থাৎ এপারের সঙ্গে ওপারের সংযোগ ঘটানোর প্রয়োজনেই এইসব সেতু গড়ে উঠেছিল। এরকম একটি সেতুর নাম হলো সিওসে পোল। ফার্সি ভাষায় সি মানে ত্রিশ ও মানে এবং আর সে মানে তিন। সিওসের অর্থ দাঁড়ায় তেত্রিশ। চমৎকার ডিজাইনের তেত্রিশটি খিলানের ওপর নির্মিত হয়েছে এই সেতুটি। সেজন্য এর নামকরণ করা হয়েছে সিওসে পোল। ইস্ফাহানে যতগুলো সেতু রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সেতু এটি।

চহরবাগ আব্বাসি সড়কের একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত এই সেতু। তিন শ মিটার লম্বা এবং চৌদ্দ মিটার প্রস্থের এই সেতুটি প্রথম শাহ আব্বাসের আদেশে নির্মাণ করা হয়। রাতের বেলা এই সেতুর ওপর গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে আপনার মন আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠবে নি:সন্দেহে। সুযোগ পেলে অবশ্যই যাবেন আশা করি। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ