পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-৫)
গত কয়েকটি আসরে আমরা ভোগবাদ নিয়ে কথা বলেছি। ভোগবাদ কীভাবে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও গোটা পৃথিবীকে প্রভাবিত করছে তা নিয়ে আলোচনা করেছি।
আমরা বলেছি, বিজ্ঞাপন আমাদের মধ্যে ভোগের সংস্কৃতি গড়ে তুলছে এবং ব্যক্তির পরিচিতি বিনির্মাণ করছে। ব্যক্তির পরিচিতির সঙ্গে পণ্যের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ব্যক্তি ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে চায়। ভোগবাদী সমাজে একজন মানুষের পরিচিতি ও ব্যক্তিত্ব নির্ধারিত হচ্ছে তার ভোগ্যপণ্যের ধরণের ভিত্তিতে। ব্যক্তি কী ধরণের ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করছে এবং ভোগ্যপণ্যটি কোন ব্র্যান্ডের তা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ কারণে অনেকের মধ্যে ঋণ করে ভালো ব্র্যান্ডের ভোগ্যপণ্য কেনার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবণতা কেড়ে নিচ্ছে মানুষের স্বস্তি। ভোগবাদের প্রভাবে সমাজে দুর্নীতিও বাড়ছে। ভোগবাদিতা চরিতার্থ করতে বনাঞ্চল ধ্বংস করে ক্রমাগত স্থাপন করা হচ্ছে কল-কারখানা। আজকের আসরে আমরা নগরায়ন সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করব। আশাকরি শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই আছেন।
ইরানের প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিভিন্ন উপলক্ষে দেওয়া বক্তৃতায় ইসলামি লাইফ স্টাইল বা জীবনপ্রণালীর নানা ইতিবাচক দিক তুলে ধরার পাশাপাশি পশ্চিমা লাইফ স্টাইলের ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন। পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লবের পর যে প্রবণতাটি গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে তা হলো নগরায়ন। শিল্প বিপ্লবের আগে পাশ্চাত্যে শহর গড়ে উঠতো গির্জার মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ভিত্তি করে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার পর থেকে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে শহর সম্প্রসারণ শুরু হয়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শহর মানুষের বৈষয়িক সব সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। শহরগুলোতে বিশাল আবাসিক কমপ্লেক্স ও আকাশচুম্বী দালান নির্মিত হয়েছে। কাজের সুযোগ, অবকাশ যাপন ও নানা বিনোদনের ব্যবস্থা হয়েছে শহরেই। টেলিফোন, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট যোগাযোগের মতো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা শহরবাসীর জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। বর্তমানে শহরগুলোতে সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা মানুষকে সেদিকে টানছে, মানুষও মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে ছুটছে। কিন্তু শহুরে জীবন কি সত্যিই প্রাণবন্ত?
আমরা যদি মানুষের জীবন-প্রণালীর ওপর নগরায়নের প্রভাব নিয়ে কথা বলি তাহলে দেখতে পাব, নানা ধরণের সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শহরের মানুষ প্রকৃত সুখী নয়, সব উপকরণ থাকারও পরও তারা মানসিক সুখ অনুভব করেন না। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী হেনরি লুফবেভেরসহ অনেকেই মনে করেন, পাশ্চাত্যের শহুরে জীবনে রয়েছে অপ্রকাশ্য আত্মবিস্মৃতি। তিনি মনে করেন, দ্রুত নগরায়নের কারণে ভোগবাদ যেমন মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরছে তেমনি কৃত্রিম চাহিদা মানুষের সুখ-শান্তি ও স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে। তার মতে, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রবণতার সমালোচনা করে তিনি আরও বলেছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নির্ভর নগরগুলোতে মানুষের জীবন একঘেয়ে ও বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। এ ধরণের সমাজের মানুষ প্রতিদিন একই ধরণের কাজ করতে করতে এক ধরণের ক্লান্তি অনুভব করেন এবং প্রকৃত শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ থেকে বঞ্চিত হন। তারা সৃজনশীলতা ও বিকাশ লাভের সুযোগ হারান।
বর্তমান সময়ে পাশ্চাত্য সমাজে যেসব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার প্রধান উৎস হচ্ছে নগরায়ন। শহরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বেশ পুরনো। কিন্তু ইতিহাসে কখনোই নগরায়নের প্রবণতা মানুষের মানসিক প্রশান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি। বর্তমান যে নগরায়ন, সেটাকে উন্নয়ন রোগ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। মানসিক সমস্যার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। জার্মানির ম্যান হেইম শহরের মানসিক রোগ নিয়াময় কেন্দ্রের পরিচালক এন্ড্রেস ম্যায়ের লিন্ডেনবার্গ সতর্ক করে বলেছেন, শহুরে মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। তবে এই রোগের বিস্তারকে খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না সমাজ ও রাষ্ট্র। তার মতে, পাশ্চাত্যের বড় শহরগুলোতে অতিমাত্রায় শব্দ দূষণ, ভিড়ের চাপ ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা মানুষের মধ্যে মানসিক উত্তেজনা ও অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাহ্যিকভাবে আধুনিক এই সমাজ বেশ সাজানো-গোছানো মনে হলেও ভেতরে প্রতিনিয়ত ভাঙনের করুন সুর বাজছে।
মানুষ যেমন পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তেমনি প্রতিদিনের নানা ঘটনা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে তুলছে। সবাইকে এক ধরণের প্রতিযোগিতার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কারণে মিটিংয়ে পৌঁছাতে দেরি হওয়া, বিমানের ফ্লাইট মিস করা, পার্কিংয়ের জন্য নিষিদ্ধ স্থানে গাড়ি রাখা, পুলিশের উপস্থিতি এবং ভাষণে ত্রুটির মতো নানা ঘটনা প্রতিনিয়ত মানুষের টেনশন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ধরণের মানসিক উদ্বেগ ও উত্তেজনা পাশ্চাত্যের মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। মাত্র ৬০ বছর আগেও বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বড় শহরগুলোতে বাস করতো, কিন্তু বর্তমানে এ সংখ্যা পঞ্চাশ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই শহরমুখী হবে এবং বড় শহরগুলোর বাসিন্দা হয়ে উঠবে।
গবেষকরা বলছেন, আধুনিক শহুরে জীবন ব্যবস্থা মানুষকে ক্রমেই ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে মানুষ আরও বেশি একঘরে হয়ে পড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের সহযোগিতা ছাড়াই অনেক কাজই সম্পন্ন করা যাচ্ছে। এ কারণে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা কমে যাচ্ছে। শহরের মানুষ সহজেই অন্যের সঙ্গে আর যোগাযোগ করছে না। মানুষের হাতে বর্তমানে গণযোগাযোগের সবচেয়ে উন্নত মাধ্যম থাকা সত্ত্বেও একাকীত্ববোধ বাড়ছে। পাশ্চাত্যের অধিবাসীদের একটা বড় অংশই এখন মোবাইলের বাটনে একটি চাপ দিলেই ইন্টারেনেটের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় কেনাকাটাও সম্পন্ন করতে পারছে এবং সবচেয়ে বড় ও জটিল লেনদেন সম্পন্ন করতে পারছে। বিক্রেতা বা ক্রেতার সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন ও দেখাসাক্ষাৎ করার প্রয়োজন পড়ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গিয়েই শিক্ষা গ্রহণ, অফিসে উপস্থিত না হয়ে নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ কারণে সামনা-সামনি দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।