অক্টোবর ০৫, ২০২০ ১৮:২০ Asia/Dhaka

মহানবীর (সা) অনুপম শ্রেষ্ঠ মানবীয় গুণাবলী আর মহানুভতায় মুগ্ধ হয়েছেন যুগে যুগে প্রাচ্য ও প্রাচ্যের বহু অমুসলিম মনীষী।

তাই তাদের অনেকেই এটা বুঝতে পেরেছেন যে সব ধরনের প্রতারণা আর মিথ্যার মোকাবেলায় ইস্পাতকঠিন ও সত্যের পক্ষে পাহাড়ের মত অবিচল সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)। সভ্যতার সব ধরনের অচলাবস্থা ও সংকটের সমাধান দিতে সক্ষম ছিলেন তিনি।

আসলে  বিশ্বে মানুষের মর্যাদা ও ভ্রাতৃত্ব জোরদারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখার কারণে কোনো বিবেকবান মানুষই মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক মহানবীর (সা) প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও ভালবাসাকে গোপন রাখতে সক্ষম নন। মহান আল্লাহর অজস্র দরুদ ও সালাম পেশ করছি এই মহামানব এবং তাঁর পবিত্র বংশধরদের প্রতি।

প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা) শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার গত পর্বে আমরা ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে ব্রিটেনের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও গবেষক আর্নল্ড টয়েনবির প্রশংসাসূচক দুই একটি মন্তব্য তুলে ধরেছি। আজ এ বিষয়ে আরও খানিকটা দৃষ্টি দেব। বিংশ শতকের পশ্চিমা এই চিন্তাবিদের মতে মদিনায় মহানবীর (সা) হিজরতের সুবাদে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে ও ইসলামের অগ্রগতি জোরদার হয়। টয়েনবি লিখেছেন: ‘মহানবী (সা) মদিনায় এসে সেখানকার ধর্মীয় নেতা হিসেবে সেখানকার নানা গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এ ছাড়াও মক্কায় যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাদেরকেও পারস্পরিক আপোষ-রফার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করেন তিনি। মক্কার এই মুসলমানরা মদিনায় এসে মহানবীর সঙ্গে যুক্ত হন। মদিনার বেশিরভাগ অ-ইহুদি পুরোপুরি স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এভাবে ইসলাম ধর্ম স্থানীয় ও মুহাজির বা আশ্রয় গ্রহণকারী লোকদের মধ্যে এক দৃঢ় ঐক্য বা বন্ধন গড়ে তোলে।

টয়েনবি খ্রিস্ট হযরত ঈসা (আ)’র সঙ্গে মহানবীর (সা) তুলনা করে লিখেছেন: হযরত ঈসা যখন গ্রেফতার হন সে সময় রাজনৈতিক পরিবেশ তাঁর জন্য অনুকূল ছিল না।  ঈসা নবী ছিলেন রোম সাম্রাজ্যের একজন নাগরিক। তিনি যদি সে সময় বিদ্রোহ করতেন তাহলে বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হত এবং এ বিদ্রোহের ফলে তিনি সামরিক বিজয়ও অর্জন করতেন না। অন্যদিকে ইসলামের নবীর বিজয়ের কোনো ধরনের সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু একজন নেতা হিসেবে তাঁর বিজয় ইসলামকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে দেয়। (হযরত ঈসার গ্রেফতার হওয়ার যে কথা টয়েনবি বলেছেন তা সত্য ইতিহাস নয় বলে মুসলমানরা মনে করেন। এই মহান নবী গ্রেফতারও হননি ও তাই তাঁকে হত্যাও করা হয়নি। হযরত ঈসার মত কোনো এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়।)

টয়েনবি ভবিষ্যতে খ্রিস্ট ধর্মের বিস্তার সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ‘পরীক্ষার মানদন্ডে বা পাত্রে সভ্যতা’ শীর্ষক তার বইয়ে সভ্যতাগুলো সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশ্বে ইসলাম ধর্মের অচলাবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন:

প্যান-ইসলামিজম তথা বিশ্ব-মুসলিমকে কেবল ইসলামী আদর্শের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ করার জাগরণী আন্দোলন স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের দরিদ্ররা যদি পাশ্চাত্যের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে  বিদ্রোহ করে তাহলে এই ঘুমন্ত আন্দোলন আবারও জেগে উঠবে এবং এই বিদ্রোহের গর্জন ইসলামী চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ইসলাম আবারও তার ঐতিহাসিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে জেগে উঠবে।

বিংশ শতকের আরেক প্রখ্যাত পশ্চিমা ইতিহাসবিদ ও মনীষী উইলিয়াম জেমস্ ডুরান্টও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে এ সম্পর্কে উদার ও যৌক্তিক প্রশংসাসূচক মন্তব্য করতে দ্বিধান্বিত হননি। মার্কিন এই গবেষক ‘ইসলামী সভ্যতা’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সভ্যতা গড়ার চালিকাশক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ‘সভ্যতার ইতিহাস’ শীর্ষক ১১ খন্ডের একটি বই লিখেছেন। এ বই লেখার কাজে তার স্ত্রীও তাকে সহায়তা দিয়েছেন। উইল ডুরান্ট তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বইয়ে ইতিহাস বিশ্লেষণের এক নতুন ধারা তুলে ধরেছেন অতীতের নানা ঐতিহাসিকের লেখা ব্যবহার করে।

সভ্যতাগুলোর উত্থান ও পতন ইতিহাসের একটি বাস্তব-রীতি ও খোদায়ী বিধান। বঞ্চিত ও দুর্বলদের বিজয় যেমন চিরস্থায়ী হয় না তেমনি কর্তৃত্বকামীদের শক্তিও চিরস্থায়ী নয় এবং দুর্বলরা যে চিরকাল ক্ষমতা থেকে দূরে থাকবে তাও সত্য নয়। পবিত্র কুরআনের সুরা কাসাসের পঞ্চম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: আমরা দুর্বল বা বঞ্চিতদেরকে পৃথিবীতে মানবজাতির নেতৃত্ব দান করার এবং তাদেরকে পৃথিবীর ক্ষমতার উত্তরসূরী করার ইচ্ছা করেছি।

উইল ডুরান্ট মনে করেন নৈরাজ্য, নিরাপত্তাহীনতা ও অরাজকতা শেষ হলে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। মানুষ যখন ভয়হীন হয় কেবল তখনই কৌতুহলী হয় ও উদ্ভাবন আর আবিস্কারের দিকে সক্রিয় হয়। এমন শান্ত পরিবেশেই মানুষ জ্ঞান অর্জনে ও মানুষের জীবনের উন্নয়নে আগ্রহী হয়। 

ডুরান্টের লেখা সভ্যতার ইতিহাস শীর্ষক বইয়ের প্রথম খণ্ডটির নাম হল প্রাচ্য: সভ্যতার সুতিকাগার বা দোলনা। এই খণ্ডে ইরানের সভ্যতা, শিল্প ও সংস্কৃতি নিয়েও মনোজ্ঞ আলোচনা রয়েছে। একই খণ্ডে তিনি ইসলামের মহানবীর প্রশংসা করেছেন এবং মহানবীর শিক্ষার আলোকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের খুব দ্রুত বিকাশ ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন। ডুরান্ট লিখেছেন: ইসলামী সভ্যতায় তথা হিজরি ৮১ সন থেকে ৫৯৭ সন পর্যন্ত বা খ্রিস্টিয় ৭০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে  নানা ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ অগ্রগতি ঘটেছিল।

মহানবীর প্রশংসা করে মার্কিন মনীষী উইল ডুরান্ট লিখেছেন: মহাপুরুষরা কতটা মহৎ বা শ্রেষ্ঠ তা বিচারের মানদণ্ড হয় যদি প্রভাব তাহলে আমাদেরকে বলতে হবে যে মানব-ইতিহাসে মহৎদের মধ্যে বা মহাপুরুষদের মধ্যেও মুহাম্মাদ (সা) হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ