অক্টোবর ২০, ২০২০ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে বিষন্নতা ও হতাশা নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো বর্তমান লাইফ স্টাইল।

‘ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা থেকে মুক্তি সম্ভব’ শিরোনামের বইয়ের লেখক ও মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টিফেন ইলদারি’র মতে,পাশ্চাত্য সমাজে ব্যাপক মাত্রায় যে বিষন্নতা ছড়িয়ে পড়েছে তা সাধারণ ও প্রাকৃতিক নিয়মে সৃষ্ট কোনো সমস্যা নয়। এর পেছনে রয়েছে শিল্পোন্নত সমাজের বর্তমান লাইফ স্টাইল বা জীবনযাপন পদ্ধতি। তিনি মনে করেন,মানুষের জন্মগত ব্যবস্থা ও কাঠামোর সঙ্গে পাশ্চাত্যে বিদ্যমান জীবন পদ্ধতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার মতে, বিষন্নতা আসে দীর্ঘদিনের স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকে। মানুষের ব্রেইন দীর্ঘ দিনের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ সহ্য করতে না পেরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। পাশ্চাত্যের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে এ ধরণের সমস্যা মোকাবেলা করে জীবনযাপন করছেন  এটা দীর্ঘমেয়াদে অত্যন্ত বিপজ্জনক। একটানা মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে। নিয়মিত ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। বিশেষকরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং নানা ধরণের ইনফেকশনের কারণ হতে পারে।

অধ্যাপক স্টিফেন ইলদারি আরও বলেছেন, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষন্নতার ওষুধ খেলেই এ ধরণের সমস্যার স্থায়ী সমাধান পাওয়া সম্ভব নয় বরং এ জন্য লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করতে হবে। গবেষকদের নানা গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট, প্রত্যেক মানুষের দৈনিক অন্তত আট ঘণ্টা ঘুম দরকার। এর চেয়ে কম সময় ঘুমালে মানসিক চাপ ও অস্থিরতা বাড়ে এবং এক সময় তা চরম পর্যায়ে গিয়ে বিষন্নতায় রূপ নেয়। অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি বিষন্নতার সঙ্গে ঘুমের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে অন্তত আট কোটি মার্কিন নাগরিক নানা কারণে আট ঘণ্টা ঘুম পূর্ণ করেন না। এরে ফলে তাদের অনেকেই হতাশা ও বিষন্নতার মতো সমস্যার সম্মুখীন হন। এদের বেশিরভাগই হলো নারী। আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার এক তৃতীয়াংশ মানুষ এমন কিছু ওষুধ ব্যবহার করেন যা বিষন্নতা বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ দৈনিক এমন তিন ধরণের ওষুধ সেবন করেন যা বিষন্নতা সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রাখে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে অগ্রগ্রামী দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকা ও ব্রিটেনের মানুষ এ ধরণের সমস্যায় বেশি ভুগেন। মার্কিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর সেদেশের ৫ কোটি ৬০ লাখ নাগরিক বিষন্নতা ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগেন। ব্রিটেনের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। এ কারণে ব্রিটেনে একাকীত্বের মতো সমস্যা নিরসনের জন্য নানা ধরণের ক্যাম্পেইন ও কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এছাড়া ব্রিটেনে একাকীত্ব নিরসনে মন্ত্রণালয়ও গঠন করা হয়েছে। ব্রিটেনের নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটিতে ২০ লাখ মানুষ বিষন্নতায় ভুগছেন। ব্রিটেনের একটি ডেটা অ্যানাইসিস কোম্পানির কর্ণধার জোডি এড্রিড বলেছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশিও হতে পারে। কারণ অনেকে এ সমস্যায় ভুগলেও চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন না। ২০১৬ সালে ব্রিটেনে বিষন্নতার মতো সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ছয় কোটি ৪০ লাখ ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন লিখেছেন চিকিৎসকেরা। গত দশ বছরের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, সংখ্যাগত দিক থেকে এ ধরণের ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার পরিমাণ ১০০ ভাগ বেড়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেনে এই সমস্যা তুলনামূলক বেশি। এর পেছনে বড় কারণ হচ্ছে পেশাগত অসন্তোষ ও শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতা। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোচিকিৎসা বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্রিটেনের দুই-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নানা ধরণের মানসিক সমস্যা মোকাবেলা করছেন। এর মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও বিষন্নতা অন্যতম। দুই দশক আগেও চিকিৎসকেরা বিষন্নতাকে প্রাপ্তবয়স্কদের রোগ বলে মনে করতেন। কিন্তু বর্তমানে পাশ্চাত্যে শিশু ও তরুণদের মধ্যেও বিষন্নতা বাড়ছে। ব্রিটেনের শিশু অধিকার বিষয়ক সংস্থা ঘোষণা করেছে, ২০১৫  ও ২০১৬ সালে প্রায় ১২ হাজার বার চিকিৎসকেরা এ ধরণের সমস্যার সম্মুখীন শিশু ও তরুণদের ভিজিট করেছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন। ২০১৭-২০১৮ সালে এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ ২১ হাজারের বেশি বার এ ধরণের শিশু ও তরুণ-তরুণীকে এ সমস্যা মোকাবেলায় পরামর্শ দিতে হয়েছে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশই হচ্ছে তরুণী।

উত্তর ইউরোপের দেশগুলোকে সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু এসব দেশেও শিশু ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিষন্নতা ও একাকীত্ববোধের মতো সমস্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। গবেষণা ভিত্তিক তথ্য বলছে, তরুণ-তরুণীদের মাঝে মানসিক চাপ, মানসিক উত্তেজনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং বিষন্নতা  বেড়েছে। এ কারণে বিষন্নতার ওষুধ খাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। সৌভাগ্যের অনুভূতি নিয়ে গবেষণায় নিযুক্ত কোপেনহেগেনের একটি প্রতিষ্ঠান বলছে, উত্তর ইউরোপের দেশগুলোতে ১২ শতাংশের বেশি মানুষ নিজেকে একদম সুখী বলে মনে করেন না বরং তারা বেঁচে থাকাটাকেই কষ্টদায়ক বলে বিশ্বাস করেন। এই সংখ্যার মধ্যে ১৩ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সী। ডেনমার্ক ও সুইডেনে এই সমস্যা পুরুষের চেয়ে নারীর মধ্যে বেশি। নরওয়েতে পাঁচ বছরে এই প্রবণতা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। 

২০১৮ সালে ফিনল্যান্ডকে সবচেয়ে সুখী দেশের খেতাব দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। কিন্তু সেখানেও এই সমস্যা প্রকট। 
১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী শিশু ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। এই বয়সে মৃত্যুর মধ্যে এক তৃতীয়াংশই আত্মহত্যা। শিশু ও তরুণ-তরুণীরা ছাড়াও ৮০ বছর বয়সীদের মধ্যে বিষন্নতা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেশি লক্ষ্য করা যায় এসব দেশে। শারীরিক সমস্যা ও একাকীত্ব বৃদ্ধদের বিষন্নতার একটি বড় কারণ।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ