প্রখ্যাত ইরানি নারী গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিবি মোনাজ্জামে'র জীবন ও অবদান
আজ আমরা হিজরি সপ্তম শতকের তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি নারী গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিবি মোনাজ্জামে'র জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
প্রখ্যাত ইরানি নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিবি মোনাজ্জামে ছিলেন যথাক্রমে খাওয়ারেজম-এর ও সালজুক সম্রাটদের রাষ্ট্রীয় জ্যোর্তিবিদ। মহাকাশ-বিজ্ঞান ও গণিত-বিজ্ঞানের ইতিহাসে সারা বিশ্বে সম্ভবত তিনিই প্রথম নারী যিনি তার অসাধারণ প্রতিভার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ হিসেবে স্বীকৃতি ও সম্মানের অধিকারী হতে পেরেছেন।
প্রাচীন ইরানের বৃহত্তর খোরাসানের নিশাপুরে ৬০০ হিজরিতে জন্ম নিয়েছিলেন বিবি মোনাজ্জামে। তার বাবা কামালউদ্দিন সেমনানি ছিলেন নিশাপুরের শাফেয়িদের তথা ইমাম শাফেয়ির অনুসারীদের প্রধান এবং সুলতান মোহাম্মাদ খাওয়ারেজমশাহের রাজ-দরবারের জ্যোতির্বিদ। বিবি মোনাজ্জামের মা ছিলেন খোরাসানের প্রখ্যাত ইসলামী আইনবিদ বা ফক্বিহ মোহাম্মাদ বিন ইয়াহিয়ার নাতনি। বাবা জ্যোতির্বিদ তথা গ্রহ-নক্ষত্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হওয়ায় বিবি মোনাজ্জামেও এই পথের পথিক হন এবং এক্ষেত্রে এত বড় মাপের বিশেষজ্ঞ হন যে সুলতান জালালউদ্দিন খাওয়ারেজমশাহের দরবারে এবং পরবর্তীকালে সম্রাট আলাউদ্দিন কায়কোবাদের দরবারেও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে স্থান করে নিতে সক্ষম হন।
বিবি মোনাজ্জামে এ নামেই খ্যাতি অর্জন করেন যদিও তা তার আসল নাম নয়। গ্রহ-নক্ষত্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণেই তিনি এই নামে খ্যাতি অর্জন করেন। উল্লেখ্য, কেউ কেউ তাঁর নাম মোনাজামেও বলেও উচ্চারণ করেন। বিবি মোনাজ্জামে জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব-নিকাশ ও এ সংক্রান্ত পরিমাপ এবং সে যুগের যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বেশ দক্ষ ছিলেন এবং জ্যোতির্বিদ্যার নানা সূত্র ও বিধানের বিষয়ে বিশেষজ্ঞসূলভ মতামত ব্যক্ত করতেন। জ্যোতির্বিদ্যা সংশ্লিষ্ট নানা বিদ্যায়ও অসাধারণ পারদর্শি ছিলেন তিনি। বিবি মোনাজ্জামে তার বাবার কাছ থেকেই এইসব বিদ্যার তালিম পেয়েছিলেন। বিবি মোনাজ্জামের স্বামী মাজ্দ্উদ্দিন মোহাম্মাদ ছিলেন গোরগান অঞ্চলের অধিবাসী এবং মহানবী (সা)'র বংশধর। তিনি ছিলেন সুলতান জালালউদ্দিন খাওয়ারেজম্শাহের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন এবং প্রথমদিকে তিনি ছিলেন একজন সচিব। পরবর্তীকালে মাজ্দ্উদ্দিন মোহাম্মাদ সালজুক সুলতানদের দরবারের অনুবাদকও হন। এরপর তিনি আমির-ওমরাহ ও রাষ্ট্রনায়কদের দরবারে যেতেন সালজুক সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রদূত হিসেবে।
জালালউদ্দিন খাওয়ারেজমশাহের দরবারে বিবি মোনাজ্জামে'র ছিল বিশেষ সম্মান। পঞ্জিকা ও জ্যোতির্বিদ্যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুলতান জালালউদ্দিন এই বিবির পরামর্শ নিতেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে বিবি মোনাজ্জামে মোঙ্গলদের সঙ্গে সুলতানের যুদ্ধের সময় বেশ কিছুকাল এই সুলতানের সঙ্গে রণাঙ্গনেও ছিলেন। বিশিষ্ট সালজুক কর্মকর্তা কামালউদ্দিন ক'মইয়ার খাওয়ারেজমশাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে বিবি মোনাজ্জামে'র খ্যাতির কথা শোনেন এবং ফিরে এসে সালজুক সম্রাটের কাছে জ্যোতির্বিদ্যায় তার পারদর্শিতার কথা সম্রাটের কাছে তুলে ধরেন।
জালালউদ্দিন খাওয়ারেজমশাহ'র শাসনামলের অবসান ঘটেছিল মোঙ্গলদের কাছে তার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। বলা হয় বিবি মোনাজ্জামে এক গণনার মাধ্যমে জালালউদ্দিনকে তার ভাইয়ের সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সুলতান তার কথাকে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ওই ভাইয়ের ষড়যন্ত্রেই মোঙ্গলদের সঙ্গে এক যুদ্ধে নিহত হন জালালউদ্দিন।
জালালউদ্দিনের মৃত্যুর পর বিবি মোনাজ্জামে ও তার স্বামী দরবারের লোকদের ক্রোধ এবং হিংসার শিকার হন। ফলে পরিস্থিতি এড়াতে তারা দামেশকে চলে যান। এরপর বিবি মোনাজ্জামে খ্যাতিমান জ্যোতির্বিদ হিসেবে আশরাফ মুজাফফরউদ্দিন মুসা আইয়ুবির রাজ-দরবারে স্থান পান। সুলতান আইয়ুবি বিবি মোনাজ্জামে ও তার পরিবারকে ব্যাপক সম্মান দেখিয়ে বরণ করেন। ওদিকে সালজুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদও এই ঘটনার কথা জানতে পারেন। তিনি সুলতান আইয়ুবির কাছে এক দূত পাঠিয়ে বিবি মোনাজ্জামে ও তার পরিবারকে কৌনিয়ায় পাঠানোর অনুরোধ করেন। ফলে তাদেরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও অনুরাগ দেখিয়ে কৌনিয়ায় আনা হয়। সালজুক সুলতান বিবি মোনাজ্জামে-কে দরবারে খুব উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আসন দান করেন। সিরিয়দের সঙ্গে সালজুকদের যুদ্ধ চলার সময় বিবি মোনাজ্জামে জ্যোতির্বিদ্যার আলোকে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে এই যুদ্ধে সালজুক সুলতান কায়কোবাদই জয়ী হবেন। ওই ভবিষ্যদ্বাণীর আলোকেই যুদ্ধ শেষ হয়। ফলে তার প্রতি সুলতানের বিশ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তিনি বিবি মোনাজ্জামেকে বিশেষ সম্মানসূচক পদক দান করেন। এই নারী বিজ্ঞানীর অনুরোধে তার স্বামীকে দারুল এনশা'র প্রধান করা হয় এবং তাকে তর্জমান উপাধিও দেন সুলতান কায়কোবাদ। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত ওই পদে বহাল ছিলেন।
বিবি মোনাজ্জামে ৬৭৯ হিজরিতে মারা যান এবং তাকে দামেস্কে দাফন করা হয়।
বিবি মোনাজ্জামের ছেলে নাসিরউদ্দিনকে বলা হত ইবনে বিবি। এশিয়া মাইনরের শেষ সালজুক সম্রাটের সমসাময়িক ছিলেন তিনি। সুলতানের ফরমান লেখক ও রাজকীয় রেজিস্ট্রার বা সিল-মোহর বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন ইবনে বিবি। নাসিরউদ্দিন একজন ঐতিহাসিক ও লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি 'তারিখে ইবনে বিবি' নামে খ্যাত বইটি লিখেছিলেন ফার্সি ভাষায়। এ বই সালজুক সুলতানদের ইতিহাস বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে স্বীকৃত। আলাউদ্দিন আতামূলক জুইয়িনির নির্দেশে প্রথম আলাউদ্দিন কায়কোবাদকে উৎসর্গ করে এ বই লিখেছিলেন ইবনে বিবি। ৬৮০ হিজরিতে এ বই লেখা শেষ হয়। বইটিতে ৫৮৮ হিজরি থেকে ৬৭৯ হিজরির ঘটনাগুলো লেখা হয়। পরবর্তীকালে ইবনে বিবির জীবদ্দশায় অন্য এক লেখক এ বইটি সরল ভাষায় সংক্ষিপ্ত আকারে লিখেছেন। সমসাময়িক যুগের গবেষক আব্বাস ইকবাল অশতিয়নি এ বইকে সালজুক ইতিহাস বিষয়ের নির্ভরযোগ্য বই বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনে বিবির মূল বইটি অবশ্য আর পাওয়া যায়নি।
ইবনে বিবি দরবারের লোক হওয়ায় তিনি নানা ঘটনার ক্ষেত্রে সুলতানদের বিষয়ে নিরপেক্ষ ছিলেন না বলে কেউ কেউ মনে করেন। বিবি মোনাজ্জামের জীবন-কাহিনী পাওয়া যায় এ বইটির মাধ্যমেই।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।