অক্টোবর ২৬, ২০২০ ১৭:২০ Asia/Dhaka

বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

ইয়াযদের স্থানীয় কুলার সিস্টেম এবং খাবার পানির ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। ইয়াযদের প্রাচীন পদ্ধতি কুলারের আধুনিক প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন। ইয়াযদে খাবার পানির ব্যবস্থাও একটু ভিন্ন ধরণের। যেহেতু মরুভূমি অঞ্চল, সেহেতু খাবার পনির সঙ্কট থাকাটাই স্বাভাবিক। এই সঙ্কট নিরসনের জন্য মাটির নীচের প্রাকৃতিক পানিই একমাত্র উপায় হিসাবে গৃহীত হয়েছে।

ভাবতেও অবাক লাগে যে, ইয়াযদে তিন হাজার একশ' একত্রিশটি কূপ বা ইন্দ্রা ছিল। অবশ্য এগুলোর মধ্যে ৫১৬টি কূপ নষ্ট হয়ে গেছে। এইসব ইন্দ্রা বর্তমান ইয়াযদবাসীদের পূর্বসূরী অর্থাৎ তাদের পূর্বপুরুষদের মূল্যবান স্মৃতির নিদর্শন। পানির সন্ধানে তারা কী ধরণের হাঁড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটেছেন, কতো অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা ঐসব কূপ খনন করে গেছেন, তা নিমিষেই ভেসে ওঠে কল্পনায়। যাই হোক শ্রোতাবন্ধুরা! আজ আমরা আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো ইয়াযদ প্রদেশের হস্তশিল্প ও তাঁত শিল্পের সঙ্গে।

ইয়াযদ প্রদেশটি উন্নতমানের গালিচা এবং তাঁত শিল্পসহ বিচিত্র রকমের হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। ইয়াযদের হাতে তৈরী কার্পেট যেমন ঐতিহ্যবাহী তেমনি দেখতেও চমৎকার। এখানকার মেশিনে তৈরী উৎকৃষ্টমানের কম্বলও বেশ প্রসিদ্ধ। রেশমি এবং পশমি কাপড়ের কারখানাও ইয়াযদে রয়েছে। ইয়াযদের কারখানাগুলোতে উৎপাদিত রেশমি ও পশমি বস্ত্র, হস্তশিল্প এবং তাঁতজাত বস্ত্রসামগ্রী এই প্রদেশের চাহিদা পূরণ করার পর ইরানের অন্যান্য প্রদেশেও সরবরাহ করা হয়। ইরানের বাজারগুলো হস্তশিল্প, তাঁতশিল্প এবং মেশিনে তৈরী কম্বল, কার্পেট ও গালিচায় সমৃদ্ধ। কিন্তু তারপরেও এখন পর্যন্ত ইয়াযদে তৈরী সামগ্রীই সবচেয়ে মূল্যবান ও উৎকৃষ্টমানের বলে বিবেচিত।

এই প্রদেশের শ্রেষ্ঠ হস্তশিল্পগুলোর মধ্যে গালিচা, সূতি শতরঞ্জি, রেশমি কাপড় এবং পশমি গালিচার নাম করা যায়। তবে এই রেশমি কাপড় এবং শতরঞ্জির জন্য ইয়াযদ তুলনাহীন। রেশমি কাপড় ইয়াযদের জনগণের হাতে তৈরী বস্তুর এক অনন্য নিদর্শন। তবে এখানে বলে রাখা দরকার যে, এই কাপড় কিন্তু বাঙালি শীতবস্ত্র নয়। এটা এক ধরনের শো-পিচ। অর্থাৎ ঘরের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশান বা অভ্যন্তরীণ সজ্জার জন্য এগুলো ব্যবহৃত হয় আবার জিনিসপত্র, এ ধরনের নক্সাকরা কাপড়ের মাঝখানে রেখে চারকোণ অথবা চারপাশ ভাঁজ করে ঢেকে রাখা হয়। এটাও এক ধরনের শো-পিস হিসেবে ঘরের শোভা বৃদ্ধি করে। এধরনের শো-পিসের ব্যবহার ইরানের নিজস্ব ঐতিহ্য। যদিও উত্তরাধুনিক বা পোস্টমডার্ণ যুগে এ ধরনের শো-পিস ব্যবহারের প্রচলন অন্যান্য দেশেও লক্ষ্য করা যায়।

বিরতির পর আবারও স্বাগত আপনাদের ইরান ভ্রমণ অনুষ্ঠানে। শো-পিস নিয়ে কথা হচ্ছিল। এই শো-পিসকে ফার্সিতে বলা হয় 'তের্মে বফি'। এর অর্থ হলো করুকাজ করা রেশমি কাপড়। এই হস্তশিল্পটির ঐতিহ্য দুই শতাধিক বছরের পুরানো। কালক্রমে এই শিল্পটি উত্তরাধিকার সূত্রে চর্চিত হতে হতে এর বুনন এবং ব্যবহার একটা রীতি-রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তের্মে বফির মূল উপাদান হলো রেশম বা সিল্ক। চড়ামূল্যের তের্মগুলো তৈরীর ক্ষেত্রে প্রায়ই প্রাকৃতিক রেশম ব্যবহৃত হয়। তবে গৃহসজ্জার জন্যই তের্মগুলো সবচে বেশী ব্যবহৃত হয়। যাইহোক সিল্কি এই বিশেষ কাপড়ের উপর বাহারি নক্সাটাই বেশি উপভোগ্য। বিচিত্র রঙের সূতা বা অন্যান্য ঝক্ঝকে বস্তু দিয়ে খুব সূক্ষ্ম কারুকাজ করা হয়। এসব রং যেমন পাকা তেমনি দৃষ্টিনন্দন। বিচিত্র কারুকার্যখচিত এই তের্মেবফি বর্তমানে ইরানের সীমা অতিক্রম করে বিশ্ব বাজারেও গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যাপক সমাদৃতি পেয়েছে। দেখতে আমাদের দেশের রুমালের মতো অনেকটা। তবে রেশমি কাপড়ের ওপর নকশি কাঁথার কাজের চেয়েও আরও বেশি জমকালো কারুকাজ করা এগুলো।

এবারে শতরঞ্জির মত সূতার তৈরীর বিশেষ কার্পেট নিয়ে কথা বলা যাক। ফার্সিতে এই বিশেষ কার্পেটটির নাম হলো যিলু। ইরান এমনিতেই কার্পেটের জন্য বিশ্ববিখ্যাত সেটা সবারই জানা। সাধারণ কার্পেটের চেয়ে ভিন্নতর এই কার্পেট বহু রকমের হয়। যিলু তেমনি একটি স্বতন্ত্র বা অনন্য এক ধরণের কার্পেট। যিলু কার্পেটেরও বুনন ভেদে উন্নত এবং সাধারণ শ্রেণীর বৈচিত্র্য রয়েছে। সবচেয়ে উন্নতমানের যিলু কার্পেট তৈরী হয় ইয়াযদের মেইবোদ শহরে। এই কার্পেট সাধারণত সূতো দিয়ে তৈরী হয়। তবে সূতোর ধরন বিভিন্ন রকমের। এক ধরনের সূতো ইয়াযদের বিভিন্ন মিল বা কারখানাতে তৈরী হয়। আরেক ধরনের সূতো আছে, এগুলো ইয়াযদের বাড়ী-ঘরে সাধারণত মহিলারা তৈরী করে।

বিরতির পর আবারও স্বাগত আপনাদের ইরান ভ্রমণ অনুষ্ঠানে। কথা হচ্ছিল মহিলাদের হাতে তৈরি সূতো নিয়ে। তারা তুলাকে বিশেষ উপায়ে সূতোয় পরিণত করেন। এই তুলা থেকে হাতে তৈরী সূতা দিয়ে যে কার্পেটগুলো নির্মিত হয়, সেগুলোর চাহিদা মেশিনে তৈরী কার্পেটগুলোর চেয়ে অনেক বেশী। যিলু বফি বা সূতির বিশেষ ধরনের ইয়াযদি কার্পেটটির ঐতিহ্যও বেশ প্রাচীন। প্রায় কয়েক শতাব্দি ধরে এর ব্যবহার ও বুননের প্রচলন চলে আসছে।

যাই হোক এবারে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। ইরানে ওলি-আওলিয়া বা বুজর্গানে দ্বীনের অনেক মাযার রয়েছে। পরম শ্রদ্ধাভরে ইরানী জনগণ এইসব মাযারে যান। সারা বছর ধরেই তাদেরকে মাযারে যাওয়া-আসা করতে দেখা যায়। সেখানে গিয়ে নামায পড়া, তাসবীহ তাহলীল করা, দোয়া-খায়ের করার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক।

একইভাবে মসজিদগুলোও নামায-কালাম সহ অন্যান্য কাজে মোটামুটি জনপূর্ণ থাকে। বিভিন্ন রকমের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, বই-পুস্তক পড়া, কোরান তেলাওয়াত করা ইত্যাদি মসজিদে নিয়মিত হয়ে থাকে। এইসব মাযার এবং মসজিদে ১২ মাস কার্পেটের ব্যবহার হয়ে থাকে। ফ্লোরে তো বটেই, বারান্দা এবং মসজিদের আঙিনাতেও কার্পেটের ব্যবহার রয়েছে এইসব স্থাপনায়। ইয়াযদের মসজিদ এবং মাযারগুলোতে এই যিলু কার্পেটের নিদর্শন এখনো দেখতে পাওয়া যায় মেইবুদ শহরের জামে মসজিদে । প্রাচীন এই কার্পেটটি প্রায় ৬০০বছর আগে বোনা হয়েছিল। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ