মরমি কবি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ-এর জীবনের নানা দিক
আজ আমরা ইরানের সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী সুফি-সাধক বা আরেফ ও মরমি কবি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ-এর জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলব।
হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ ছিলেন হিজরি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের তথা খ্রিস্টিয় নবম ও দশম শতকের একজন রহস্যবাদী, সুফি বা আরেফ ও মরমি কবি। তিনি তার জীবন, বক্তব্য ও মৃত্যুর মাধ্যমে বিশ্বে এত ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন যে হাজার বছর পর আজও তার সম্পর্কে বক্তব্য রাখছেন এবং লেখালেখি করছেন পশ্চিমা ও ইরানি গবেষকরা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে তার বিপুল সংখ্যক অনুরাগী। বিশেষ করে সুফি মহলে তার অনুরাগীর সংখ্যা ব্যাপক। অবশ্য তার অনেক বিরোধীও রয়েছেন মুসলমানদের বিভিন্ন ধারা ও মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে। মনসুর হাল্লাজ-এর জীবনের নানা দিক বিশ্লেষণ করেছেন পশ্চিমা গবেষক ও প্রাচ্যবিদরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বিতর্কিত সুফি ও সাধকের জীবনের প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হয়নি। সম্ভবত এ বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হল, খোদাপ্রেমের এমন এক গভীরে ও নতুন জগতে তিনি বিচরণ করেছেন যে তা সাধারণত সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। তাই হাল্লাজকে বলা হয় রহস্যের গভীরে নিমগ্ন মনসুর হাল্লাজ। মনসুর হাল্লাজ-এর কথা ও কাজে এইসব রহস্যের প্রভাব পড়েছিল বলে মনে করা হয়।
হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজকে নিয়ে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি গবেষণা করেছেন তিনি হলেন লুয়ি ম্যাসিনোন। মনসুর হাল্লাজের আসল নাম হোসাইন। তার বাবার নাম ছিল হাল্লাজ। প্রাচীন সূত্রগুলোতে তার জন্ম-তারিখ দেখা যায় না। ইসলামী বিশ্বকোষে তার জন্ম-সন আনুমানিক ২৪৪ হিজরি বা খ্রিস্টিয় ৮৫৮ সন বলে উল্লেখ করা হয়। বিশিষ্ট কবি ও সুফি-সাধক জামির একটি বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী মনসুর হাল্লাজের জন্ম-সন ২৪৮ হিজরি।
ইরানের ফার্স প্রদেশের বাইদা বা বাইজা অঞ্চলের তুর গ্রাম ছিল মনসুরের জন্মস্থান। এ অঞ্চল কাপড়-বুননের জন্য বিখ্যাত ছিল। শৈশবেই পরিবারের সঙ্গে ইরাকের ওয়াসিত অঞ্চলে হিজরত করেন মনসুর হাল্লাজ। হাল্লাজ শব্দের অর্থ তুলা ধুনোকারী। প্রথম দিকে এটা তার উপাধি ছিল। কিন্তু পরে তিনি হোসাইন বিন হাল্লাজ নামেই বেশি খ্যাতি অর্জন করেন।
ইবনে খাল্লিকান-এর মতে মনসুর হাল্লাজ ওয়াসিত শহরে ঢোকার পর ঘটনাক্রমে একটি দোকানে বিপুল পরিমাণ তুলা পিটিয়ে দেন বা ধুনো করে দেন। ফলে হোসাইন বিন মানসুর সেই থেকে মনসুর হাল্লাজ নামে পরিচিত হন।
লুয়ি ম্যাসিনোন-এর মতে মনসুর হাল্লাজ-এর বাবা কাপড় বুনন শিল্পের শ্রমিক ছিলেন। আর এ জন্যই তাকে বলা হত হাল্লাজ। আর ছেলে মনসুরেরও ছিল একই পেশা। প্রাচ্যবিদ নিকলসন এটাই মনে করেন। মনসুর হাল্লাজ-এর 'হাল্লাজ' উপাধির উৎস নিয়ে আরও অনেক ধরনের মতামত ও অলৌকিক কাহিনী শোনা যায়। এইসব মত ও কাহিনী প্রামাণ্য কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। লুয়ি ম্যাসিনোন-এর মতে মনসুর হাল্লাজ-এর 'হাল্লাজ' উপাধির উৎস হল তিনি শ্রোতাদের জন্য তাদের হৃদয়ের রহস্য ও কথাগুলো বলে দিতে পারতেন। আর এ জন্য তাকে বলা হল রহস্য ধুনোকারী বা হাল্লাজুল আসরার। কিন্তু পরবর্তীতে তার উপাধি হিসেবে শুধু হাল্লাজ শব্দটি টিকে থাকে। ইবনে কাসিরসহ আরও কেউ কেউ এ অভিমতের অনুরূপ মত পোষণ করেন। মনসুর হাল্লাজ-এর আরও কয়েকটি উপাধির কথা জানা যায়। যেমন, আবুল মুয়িন, আবু আবদুল্লাহ জাহিদ ইত্যাদি।
মনসুর হাল্লাজ-এর অসাধারণ কার্যকলাপ ও নিজের প্রচারবিমুখতার কারণেই তার অনেক উপাধি দেখা যায় বলে অনেকে মনে করেন। এইসব উপাধি তার নিজেরও তৈরি হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। সমাজে নিজেকে গোপন রাখতেই হয়তো তিনি তা করেছেন। অর্থাৎ তার উপাধিগুলো নিজের তৈরি না জনগণের দেয়া তা নিয়েও সংশয় রয়ে গেছে।
শৈশবেই পরিবারের সঙ্গে ইরাকের ওয়াসিত অঞ্চলে হিজরত করেন মনসুর হাল্লাজ। বসরা ও কুফার মধ্যবর্তী এ অঞ্চলটি কৃষিকাজ ও ব্যবসাসহ নানা দিক থেকে অসাধারণ গুরুত্ব পেত। কিন্তু মনসুরের কাছে এ অঞ্চল বা শহরটিকে খুব একটা ভালো লাগত না। তিনি ১৬ বছর বয়সে ওয়াসিত ছেড়ে আহওয়াজে চলে আসেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত আলেম ও সুফি সাধক সাহল্ বিন আবদুল্লাহ শুশতারির শিষ্য ও খাদেম হন। হুজুইরি বা দাতাগঞ্জ বখশের কাশফুল মাহজুব বইয়ে এই মহান সাধকের সুফি মতাদর্শ বা তরিকাকে 'সাহলিয়্যা তরিকা' বলে উল্লেখ করেছেন।
মনসুর হাল্লাজ তার আধ্যাত্মিক সুফি সাধনা বা খোদাপ্রেম-সাধনার প্রথম পর্ব শেখেন সাহল বিন আবদুল্লাহ শুশতারি'র সান্নিধ্যে থেকে। পরবর্তীকালে যদিও হাল্লাজ-এর ও শুশতারি'র আধ্যাত্মিক ঘরানায় মতপার্থক্য দেখা গেছে, কিন্তু দৃশ্যত মনসুর হাল্লাজ তাসাওউফ বা সুফি সাধনার মূলনীতি শিখেছিলেন শুশতারি'র কাছ থেকেই। বিশেষ করে কঠোর ও কষ্টকর সাধনার ক্ষেত্রে মনসুর হাল্লাজ-এর ওপর প্রভাব পড়েছিল সাহল বিন আবদুল্লাহ শুশতারি'র। মনসুর-এর অশান্ত আত্মা ও প্রখর মেধা তাকে এক অঞ্চলে স্থির হতে দেয়নি এবং একজন শিক্ষকের কাছেই তিনি স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেননি। তাই সাহল বিন আবদুল্লাহ শুশতারি জীবিত থাকতেই তিনি সুফি তরিকার প্রথা লঙ্ঘন করে ২৬২ হিজরিতে আমরু বিন উসমান মাক্কি'র সান্নিধ্য পেতে শুশতারি'র সান্নিধ্য ত্যাগ করেন। আর এ লক্ষ্যে মনসুর হাল্লাজ বাগদাদের দিকে অগ্রসর হন। বাগদাদ সে সময় ছিল প্রখ্যাত সুফি-সাধকদের প্রতিপালন-কেন্দ্র। বাগদাদে এসে মনসুর হাল্লাজ আমরু বিন উসমান-এর মুরিদ বা ছাত্র হন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।