মরমি কবি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ-এর জীবন
গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা ইরানের সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী সুফি-সাধক বা আরেফ ও মরমি কবি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ-এর জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলব।
গত পর্বে আমরা জেনেছি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ ছিলেন হিজরি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের তথা খ্রিস্টিয় নবম ও দশম শতকের একজন বিতর্কিত রহস্যবাদী, সুফি বা আরেফ ও মরমি কবি। নানা ক্ষেত্রে তার আসল অবস্থা নিয়ে এখনও অনেক অস্পষ্টতা বিরাজ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে তার বিপুল সংখ্যক অনুরাগী। আবার তার বিরোধীদের সংখ্যাও কম নয়।
শৈশবেই পরিবারের সঙ্গে ইরাকের ওয়াসিত অঞ্চলে হিজরত করেন মনসুর হাল্লাজ। তিনি ১৬ বছর বয়সে ওয়াসিত ছেড়ে আহওয়াজে চলে আসেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত আলেম ও সুফি সাধক সাহল্ বিন আবদুল্লাহ শুশতারির শিষ্য ও খাদেম হন। এরপর ২৬২ হিজরিতে আমরু বিন উসমান মাক্কি'র সান্নিধ্য পেতে শুশতারি'র সান্নিধ্য ছেড়ে বাগদাদে আসেন মনসুর। বাগদাদে এসে মনসুর হাল্লাজ আমরু বিন উসমান-এর মুরিদ বা ছাত্র হন; কিন্তু তার এ শিক্ষক সম্ভবত বসরায় থাকতেন। তাই তার শিষ্যও তথা মনসুর হাল্লাজ দেড় বছরের জন্য বসরায় থাকেন এবং এই শিক্ষকের সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় আরও অগ্রসর হওয়ার বা পূর্ণতা অর্জনের চেষ্টা করেন।
আমরু বিন উসমান মনসুর হাল্লাজ-এর মধ্যে প্রতিভার স্বাক্ষর দেখতে পান এবং আধ্যাত্মিক সাধনার জগতে এই যুবক অসাধারণ কিছু অর্জন করবে বলে ভবিষ্যদ্বানী করেন। বসরায় আধ্যাত্মিক সাধনার দিনগুলোতেই মনসুর হাল্লাজ আবু ইয়াকুব আক্বত্বা'র কন্যাকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে নিয়ে আমরু বিন উসমান ও মনসুর হাল্লাজ-এর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বলা হয় বসরার সুফিদের নেতৃত্ব নিয়ে আমরু বিন উসমান-এর সঙ্গে আবু ইয়াকুব আক্বত্বার-এর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তারা মনসুর হাল্লাজ-এর ওপর একান্তই তাদের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব কামনা করতেন। এ দুই সুফি নেতার বিরোধ দেখে নিভৃতচারী সাধক মনসুর দুঃখ পান এবং বসরার জামে মসজিদের নির্জনবাস ছেড়ে বাগদাদে যান। এখানে তিনি প্রখ্যাত ইরানি সুফি-সাধক জুনাইদ বাগদাদি'র মুরিদ বা শিষ্য হন। জুনাইদ-এর নির্দেশে মনসুর হাল্লাজ নির্জনে থেকে ও নিরবতা অবলম্বন করে সাধনা অব্যাহত রাখেন। বসরা ও বাগদাদে নৈরাজ্য দেখা দিলে মনসুর হজব্রত পালন করতে মক্কার দিকে রওনা হন। মক্কায় এক বছর ধরে পবিত্র কাবা ঘরের কাছে থাকেন তিনি। মক্কার প্রস্তরময় পাহাড়গুলোতে কঠোর সাধনায় মগ্ন হন মনসুর হাল্লাজ।
বলা হয় মক্কায় আধ্যাত্মিক সংযম সাধনার দিনগুলোতে মনসুর হাল্লাজ কেবল একটি রুটি ও এক ঢোক পানি খেয়ে দিন কাটাতেন এবং রোদ ছেড়ে ছায়ার নীচে যেতেন না। এ সময় মক্কার সুফি সাধকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় এবং তাদের বেশ কয়েকজন তার সঙ্গী ও সহযোগী হন। এক বছর ধরে মক্কায় আধ্যাত্মিক সাধনা শেষে মনসুর হাল্লাজ মক্কার একদল সুফিসহ বাগদাদে নিজ ওস্তাদ জুনাইদ-এর কাছে ফিরে আসেন। এ সময় জনগণ মনসুরকে বড় একজন সাধক ও পীর হিসেবে বরণ করে নেয়। এ সময়ই জুনাইদ ও মনসুর আধ্যাত্মিক পরিভাষা 'সুক্র্' ও সাহু বা 'সাহ্ও্' তথা 'আধ্যাত্মিক বিশেষ উম্মত্ততা বা আনন্দ' এবং 'এ ধরনের উম্মত্ততার ব্যাপারে সতর্কতা' নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। সুক্র্ ও সাহ্ও্ বা সাহু ছিল হিজরি তৃতীয় শতকের সুফি-জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর অন্যতম। বায়েজিদ বোস্তামি ছিলেন সুক্র্-এর সমর্থক, আর জুনাইদ ছিলেন সাহ্ওো'র সমর্থক ও অনুসারী। সুক্র্ অবস্থায় সুফি বা আরেফ হয়ে পড়েন আত্মসত্ত্বার চেতনাহীন যা দেখা দেয় খোদায়ি নানা তাজাল্লি বা প্রকাশের প্রভাবে। আর সাহ্ও্ হচ্ছে এ ধরনের আত্মাহারা অবস্থা থেকে সাধারণ অবস্থায় ফিরে আসা।
সুফি-জগতে সুক্র্ ও সাহ্ওো সংক্রান্ত বিতর্ক চরমে পৌঁছেছিল হিজরি চতুর্থ শতকে। ফলে তিইফুরিইয়্যা ও জুনাইদিয়্যাহ নামের দুটি তরিকা গড়ে ওঠে। মনসুর হাল্লাজ ছিলেন সুক্র্-এর সমর্থক। ওস্তাদ জুনাইদের সঙ্গে এ নিয়ে মতভেদের কারণে মনসুর দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে বাগদাদ ত্যাগ করেন তার অনুমতি না নিয়েই। এরপর তিনি দক্ষিণ ইরানের শুশতারে আসেন ও সেখানে এক বছর বসবাস করেন। এ অঞ্চলের জনগণ তাকে সম্মান করত ও তার কথা শুনত। ফলে শুশতার ও আহওয়াজ অঞ্চলের সুফিরা ইর্ষান্বিত হন। তাদের নিন্দাবাদকে গুরুত্ব দিয়ে মনসুরের সাবেক ওস্তাদ আমরু বিন ওসমান খুজিস্তানে কয়েকটি চিঠি পাঠান। ওইসব চিঠিতে মনসুর হাল্লাজের অবস্থাকে কুৎসিতভাবে তুলে ধরা হয়। আর এতে খুবই দুঃখ পান মনসুর হাল্লাজ। এরপর তিনি মোটা কাপড়ের আলখাল্লার ওপর পরিধেয় সুফিদের নির্ধারিত আবা নামক পোশাক বা ওই জাতীয় পোশাক খুলে ফেলেন এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করে সুফিদের সঙ্গ ত্যাগ করেন।
কিন্তু এরপরও মনসুর হাল্লাজ-এর বিরুদ্ধে সুফিদের চিঠি লেখা ও নিন্দাবাদ অব্যাহত থাকায় মনসুর হাল্লাজ ৫ বছর ধরে অদৃশ্য থাকেন। এ সময় তিনি কখনও খোরাসানে ও কখনও মধ্য এশিয়ার ট্রান্স-অক্সিয়ানা অঞ্চলে কিংবা কখনও সিস্তানে ছিলেন আবার কখনও আহওয়াজে ফিরে এসে সেখানকার লোকদের সঙ্গে কথা বলতেন।
আহওয়াজে মনসুর হাল্লাজ-এর চারদিকে বহু মানুষ সমবেত হত এবং তারা তাকে রহস্য-বিদীর্ণকারী বা হাল্লাজুল আসরার উপাধি দেয়। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।