নভেম্বর ০৫, ২০২০ ১৫:৩০ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা ইরানের সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী সুফি-সাধক বা আরেফ ও মরমি কবি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ-এর জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলব।

গত পর্বে আমরা জেনেছি, মনসুর হাল্লাজ তার ওস্তাদ জুনাইদ বাগদাদির সঙ্গে  'আধ্যাত্মিক বিশেষ উম্মত্ততা বা আনন্দ' এবং 'এ ধরনের উম্মত্ততার ব্যাপারে সতর্কতা' নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। আর এই মতবিরোধের জের ধরে মনসুর বাগদাদ ছেড়ে  দক্ষিণ ইরানের শুশতারে আসেন। এ অঞ্চলের জনগণ তাকে সম্মান করত। ফলে শুশতার ও আহওয়াজ অঞ্চলের সুফিরা ইর্ষান্বিত হন। এরপর মনসুর হাল্লাজ সুফিদের সঙ্গ ত্যাগ করে সাধারণ জনগণের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করেন।

কিন্তু মনসুর হাল্লাজ-এর বিরুদ্ধে সুফিদের নিন্দাবাদ অব্যাহত থাকায় তিনি বেশ কয়েক বছর অদৃশ্য থাকেন। এ সময় তিনি কখনও খোরাসানে ও কখনও মধ্য এশিয়ায় কিংবা কখনও সিস্তানে ছিলেন, আবার কখনও আহওয়াজে ফিরে আসতেন এবং  ওয়াজ-নসিহত, প্রচার ও লেখালেখির কাজ করতেন। তিনি ২৯১ হিজরিতে আবারও হজ করতে মক্কায় যান। সেখান থেকে ফিরে বাগদাদে এক বছর থাকেন। এরপর খোদাপ্রেমের টানে হাল্লাজ আবারও মক্কা-অভিমুখী হন।

ভারত ও তুর্কিস্তান হয়ে মক্কায় গিয়ে মনসুর হাল্লাজ কাবা ঘরের পাশে দু' বছর থাকেন। হজের সময় তিনি আরাফাতের ময়দানে গিয়ে ফরিয়াদ করে বলেন: হে খোদা! আমাকে আরও বেশি দরিদ্র ও অভাবী করুন! আমাকে করুন কলঙ্কিত যাতে জনগণ আমাকে অভিশাপ দেয়। হে খোদা! মানুষ যেন আমাকে ঘৃণা করে যাতে আমার মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা কেবল যেন তোমার জন্যই হয় এবং তোমার কাছ ছাড়া আর কারো কাছে যেন আমি কৃতজ্ঞ না থাকি।

মনসুর হাল্লাজ ২৯৬ হিজরিতে আবারও বাগদাদে ফিরে আসেন এবং জনগণের কাছে প্রচার কার্যক্রম শুরু করেন। সুফিদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার পর থেকে দশ বছরে তিনি মূলত নানা অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন। অনেকে মনে করেন এ সময় তার অবস্থা ছিল খোদাপ্রেম ও সুফিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-মিশ্রিত বিচিত্র বা অস্পষ্ট এক অবস্থা। কারো কারো মতে এ সময়েই মনসুর হাল্লাজ এমন সব কাজ করেছেন যে তার ফলে তাকে গ্রেপ্তার, বন্দি রাখা ও মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।

মনসুর হাল্লাজ বাগদাদ থেকে ফিরে পশ্চিমের তাসতারিন অঞ্চলে বসবাস করতে থাকেন এবং বাজার ও মসজিদগুলোতে ওয়াজ-নসিহত আর প্রচার কাজ চালাতেন। খুব শিগগিরই তিনি বেশ অনুরাগীও পেয়ে যান। বলা হয় মনসুর হাল্লাজ তার ওয়াজ-নসিহত ও প্রচার কাজে যে সুফিবাদের কথা বলতেন তাতে ইমাম মাহদির (আ) আবির্ভাব সম্পর্কিত তত্ত্বের বর্ণনাও থাকত। বাগদাদের খলিফার মাতাসহ খলিফার খুব ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যেও মনসুর হাল্লাজের একদল অনুরাগী গড়ে ওঠায় তার বিরোধীরা ও হিংসুকরা আতঙ্কিত হয়ে তাকে ঘায়েল করার পরিবেশ তৈরি করে। মনসুরের কাব্যময় বক্তব্যই যে আকর্ষণ সৃষ্টি করত তা নয়, একইসঙ্গে কারো কারো মতে, তিনি এমন সব অদ্ভুত কাজও করতেন যা ছিল যাদু বা ম্যাজিকের মত। ফলে সাধারণ জনগণের অনেকেই তার প্রতি আকৃষ্ট হত সহজেই। তার ওইসব প্রকাশ্য তৎপরতা ছিল কারামতের বিপরীত। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন জনগণকে তার বাণীর দিকে আকৃষ্ট করতেই মনসুর এসব অদ্ভুত কাজ করতেন। তার বাণীতে থাকত খোদার প্রেম  ও খোদার সঙ্গে মানুষের ঐক্যের কথা।

মনসুর হাল্লাজ যে ধারায় তার বক্তব্য তুলে ধরতেন তা মানুষের জন্য ছিল অভিনব ও উদ্দীপনাময়। যেমন, হঠাৎ করে তিনি একটি বাজারে হাজির হতেন। চোখের পানি ফেলে উচ্চস্বরে কেঁদে কেঁদে বলতেন: হে মানুষেরা! আল্লাহর হাত থেকে আমাকে বাঁচাও! তিনি আমাকে আমার থেকে অপহরণ করেছেন এবং আমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছেন না!  তাঁর উপস্থিতি সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই, তাঁর বিরহকেও ভয় পাই, ভয় করছি না জানি এর ফলে অদৃশ্য ও বঞ্চিত হই! যে উপস্থিতির পর অদৃশ্য হওয়ার/ এবং মিলনের পর বিরহের জালে বন্দী হয় তার জন্য আক্ষেপ!-

জনতাও মনসুর হাল্লাজ-এর কান্না দেখে কাঁদত ও তাঁর পিছে পিছে চলত। এরপর কোনো এক মসজিদে পৌঁছে বক্তৃতা শুরু করতেন তিনি। বক্তৃতার কিছু কথা মানুষ বুঝত ও কিছু অংশ তারা বুঝত না।

কখনওবা মসজিদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মনসুর হাল্লাজ বলতেন: হে মানুষেরা! যখন খোদা কারো হৃদয়ের ওপর কর্তৃত্বশীল হয় তখন তাকে খোদা ছাড়া অন্য সব কিছু থেকে ধ্বংসশীল করে। খোদা যখন তার কোনো দাসকে ভালোবাসেন তখন লোকদেরকে তার শত্রু করেন যাতে ওই বান্দাহ খোদামুখী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়। কিন্তু আমার অবস্থা কেমন? আমি খোদার বিষয়ে কিছুই জানিনা ও বিন্দুমাত্রও তাঁর কাছাকাছি হইনি, তা সত্ত্বেও লোকেরা আমার সঙ্গে শত্রুতা করছে!– এ জাতীয় কথা বলে মনসুর হাল্লাজ কাঁদতেন। এ অবস্থায় বাজারের লোকেরাও কাঁদত। এমন সময় হঠাৎ হেসে উঠতেন মনসুর হাল্লাজ এবং উচ্চস্বরে হাঁক-ডাক দিতেন ও কবিতা বলতেন।

মনসুর হাল্লাজ কখনওবা কোনো মসজিদে হাজির হয়ে লোকদের বলতেন তার কথা শুনতে। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাই এ সময় তার কাছে জড় হত। এরপর তিনি লোকদের দিকে তাকিয়ে বলতেন: বন্ধুরা আমার! জেনে রাখ যে খোদা আমার রক্তকে তোমাদের জন্য বৈধ করেছেন, আমাকে হত্যা কর!-কেউ কেউ এ কথা শুনে কেঁদে ফেলত। কেউ একজন বলত: কিভাবে কাউকে হত্যা করা সম্ভব যে নামাজ ও রোজায় এবং কুরআন পাঠে অভ্যস্ত? জবাবে মনসুর হাল্লাজ বলতেন: যে জন্য আমার রক্তপাত ঘটানো দরকার তা নামাজ ও রোজা চর্চা এবং কুরআন পাঠেরও উর্ধ্বে! আমাকে হত্যা কর। তা করলে তোমরা পুরস্কার পাবে ও আমি পাব প্রশান্তি।–

মনসুর হাল্লাজ-এর অবস্থা সম্পর্কিত বর্ণনায় এ জাতীয় কথাই দেখা গেছে! যদিও এসব বর্ণনার মধ্যে প্রক্ষেপ ও অতিরঞ্জনও রয়েছে, তবুও এটাও বোঝা যায় যে মনসুর হাল্লাজ অদ্ভুত ধরনের খোদা-প্রেমের দৃষ্টান্ত ছিলেন এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস প্রচারের ক্ষেত্রেও তার পন্থা ছিল নজিরবিহীন। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।