নভেম্বর ২৫, ২০২০ ১৭:৫২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা সারা বিশ্বে বিশেষকরে পাশ্চাত্যে আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে কথা বলেছি। আত্মহত্যার নানা দিক বিশ্লেষণের পর যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে এসেছে তাহলো বৈজ্ঞানিক উন্নতি এবং অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের পরও পাশ্চাত্যের মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? আজকের আসরে এ বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।

তাঁর দৃষ্টিতে জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে একজন মানুষের লাইফস্টাইল গড়ে ওঠে। আর জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পেছনে ভূমিকা রাখে মানুষের চিন্তা-দর্শন। বর্তমানে পাশ্চাত্যের সমাজ ব্যবস্থায় যেসব সংকট দেখা দিয়েছে তার মূলে রয়েছে পাশ্চাত্য সমাজের বৈষয়িক ও সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি।  আজকের আসরে পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থার আরও কিছু দিক নিয়ে কথা বলব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত লেখক এলভিন টফলার মনে করেন,পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ প্রধান দু'টি বিপ্লবের মুখোমুখি হয়েছে। এর প্রথমটি কৃষি বিপ্লব। আর দ্বিতীয়টি শিল্প বিপ্লব। তবে বর্তমানে মানব সমাজ তৃতীয় বিপ্লব অর্থাৎ ইলেকট্রনিক বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। যেমনিভাবে শিল্প বিপ্লবের কারণে কৃষি ব্যবস্থার ক্ষতি হয়েছে ঠিক তেমনি ইলেকট্রনিক বিপ্লব শিল্প ব্যবস্থাকে উলটপালট করে দেবে। তিনি মনে করেন. শিল্প বিপ্লব থেকে ইলেকট্রনিক বিপ্লবে স্থানান্তরের যে প্রক্রিয়া তা পারিবারিক সংকটসহ পাশ্চাত্যে নানা ধরণের সংকটের জন্ম দিচ্ছে। তার একটি বইয়ের নাম হচ্ছে থার্ড ওয়েব বা তৃতীয় ঢেউ। এই বইয়ে তিনি লিখেছেন,আমরা যদি একটি পরিবার বলতে একজন চাকুরীজীবী স্বামী,একজন গৃহিণী স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে ধরি তাহলে দেখতে পাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ এ ধরণের পরিবারের অংশ। বাকি ৯৩ শতাংশ মানুষ এই মডেলের বাইরে।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এমন কয়েকজন মহিলা

এখন সবার মুখেই শোনা যাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে পরিবার প্রথা ভেঙে পড়বে। পরিবার এখন বর্তমান সময়ের প্রধান ইস্যু। পরিবার হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে ছোট সামাজিক প্রতিষ্ঠান। একটি সমাজ গঠনে এর অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। স্বামী ও স্ত্রী পরিবার গঠনের মাধ্যমে তাদের সবচেয়ে বড় চাহিদা অর্থাৎ প্রশান্তি লাভ করে।  বাস্তব মাতৃগর্ভে জন্ম নিলেই একটি শিশু মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে না। মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার জন্য তাকে মূল প্রশিক্ষণ দেয় তার পরিবার। কাজেই একটি সভ্যতা নির্মাণের জন্য পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,পাশ্চাত্যে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটি আজ বিপর্যয়ের মুখে। পরিবারই যে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়, সে কথাটি যেন পাশ্চাত্যের সরকার ও নীতিনির্ধারকরা ভুলতেই বসেছেন। পরিবার যে উচ্চতর এক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গড়ে ওঠে, তারা পরোক্ষভাবে তা অস্বীকার করছেন। আসলে সুস্থ ও সমৃদ্ধ পরিবার একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ ও সভ্যতার জন্ম দেয়। অন্যদিকে,পারিবারিক বিপর্যয় সভ্যতা ধ্বংসের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে।

পারিবারিক জীবনে অনাবিল শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে পরিবার হয়ে ওঠে সব উদ্যম, প্রেরণা ও প্রশান্তির ক্ষেত্র। তেমন একটি পরিবারই সমাজকে ইতিবাচক অর্থে সার্থকভাবে কিছু দিতে পারে, যা সুস্থ সামাজিক জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। পরিবার প্রথার বন্ধনকে আঁকড়ে ধরে রাখা না হলে পাশ্চাত্যের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়ে যাবে। পরিবার প্রথায় বিপর্যয় নেমে এলে সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটবে। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরাই বলছেন,মানুষের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু সব কিছু জেনেও পাশ্চাত্যের মানুষ নিজেই নিজের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। পরিবারের সদস্যরা তাদের ভূমিকা ও দায়িত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ কারণে পাশ্চাত্যে নারীরা মা ও স্ত্রী হিসেবে তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। একজন পুরুষও পরিবারের প্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। বাবা-মায়েরা নিজেদের বিনোদন ও স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সন্তান লালন-পালন তথা পরিবার ব্যবস্থাপনা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। পাশ্চাত্যের পরিবারগুলোর এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিই ওই সমাজের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনছে। সমাজবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাশ্চাত্যে ক্রমেই পরিবার-প্রথার বিলোপ ঘটার কারণ হচ্ছে বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা।

সন্তানরা তাদের মা-বাবার কাছ থেকে আচার-আচরণ ও শ্রদ্ধাবোধ রপ্ত করে। এ কারণে সন্তানদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও সম্মান পেতে হলে নিজেদেরও সদাচারী হতে হবে এবং নিজেদের পক্ষ থেকেও অন্যদের সম্মান দেখাতে হবে। যে পরিবারের সন্তানরা মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করে না,সেই পরিবারে প্রকৃত সুখ আসে না। কিন্তু বর্তমানে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে পরিবার ব্যবস্থার একটি বিকল্প গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। শিশুদের জন্য দুগ্ধপান ও পরিচর্যা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে এবং মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা বিশেষকরে বৃদ্ধ মানুষদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে।  এর ফলে দেখা যাচ্ছে পরিবারের সদস্যরা একে অপর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, একে অপরের মধ্যে কাছাকাছি অবস্থানের সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে। শুধু মানসিক দিক থেকে দূরত্ব নয়, শারীরিক উপস্থিতির ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এর ফলে মানুষের অজান্তের বাসা বাধছে একাকীত্ব ও মানসিক যন্ত্রণা। পাশ্চাত্যে নারী ও পুরুষের মধ্যে একা বসবাসের প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

গত 30 বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে,  ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে একা বাস করেন এমন মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এসব দেশের মানুষ অনেক দেরিতে বিয়ে করেন এবং তালাকের হারও সেখানে অনেক বেশি। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দপ্তর জানিয়েছে, ৩৩ শতাংশ পরিবারে এখন কেবল একজন সদস্য রয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে সুইডেনে অবস্থা সবচেয়ে খারাপ এখানে প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবারে একজন সদস্য রয়েছেন। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে ২৫ শতাংশ পরিবারের কোনো সন্তান নেই। এছাড়া আমেরিকায় 16 বছরের বেশি বয়সী মানুষদের ৫০ শতাংশই অবিবাহিত। গত তিন দশকের হিসাবে দেখা গেছে, প্রায় 20 শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তার জীবনসঙ্গীর সঙ্গে কিছু দিন কাটানোর পর তালাক নিয়েছেন। #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।