ডিসেম্বর ০৭, ২০২০ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

আমরা ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানি যোদ্ধাদের চালানো ‘রমজান’ অভিযান নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম।

 

খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করার পর ইরান যে প্রতিরক্ষানীতি গ্রহণ করে তা হচ্ছে- আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দু’দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালানো।  ওদিকে যুদ্ধের এ পর্যায়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সমাজের পক্ষ থেকে যেসব শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হচ্ছিল তার কোনোটিতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। উল্টো এসব পরিকল্পনা থেকে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছিল ইরান যাতে এই যুদ্ধে বিজয়ী না হয় সেটা নিশ্চিত করা ছিল এসব পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক সমাজ বরং ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দামকে সম্মানজক উপায়ে ইরান থেকে বরে করে নেয়ার উপায় খুঁজছিল।

গিনির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ‘আহমাদ সেকু তোরে’ ১৯৮২ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর কাছে বার্তা পাঠিয়ে একটি শান্তি পরিকল্পনার প্রস্তাব দেন।  ২রা জুলাই ইমাম ওই বার্তার জবাবে বলেন: “আপনি একটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন যে, আমরা আগে যুদ্ধ শুরু করিনি বরং ইসলাম প্রতিটি মুসলমানকে আত্মরক্ষা করার যে অধিকার দিয়েছে সেই অধিকারবলে আমরা আত্মরক্ষা করে যাচ্ছি। এ অবস্থায় যদি কেউ যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে বাধ্য থাকে সে হচ্ছে সাদ্দাম, আমরা নই।” ওদিকে খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের পর সাদ্দাম বুঝতে পারে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তার নয়া রণকৌশল দরকার। এ কারণে কৌশল হিসেবে সে ইরানের বেশিরভাগ এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে এবং রাজনৈতিক ও প্রচারণাগত কাজে বিষয়টিকে ব্যবহার করে। 

ইরান থেকে সরে গেলেও ইরাকি বাহিনী নিজেদের ভূমি রক্ষার উদ্দেশ্যে পুরো সীমান্ত জুড়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে। এ সময় তারা ইরানি যোদ্ধাদের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ রোধ করতে সীমান্ত ফ্রন্টগুলোতে নজিরবিহীন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।  

ইরাকি শাসক সাদ্দাম খোররামশাহরে বড় ধরনের পরাজয়ের সম্মুখীন হওয়ার পর যেকোনো মূল্যে তার দেশে ইরানি যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ রোধ করার পরিকল্পনা হাতে নেয়।  এ লক্ষ্যে বাগদাদ যুদ্ধের ময়দানকে এমনভাবে ঢেলে সাজায় যাতে ইরানি যোদ্ধারা তাদের দখল হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট ভূমি পুনরুদ্ধার করতে না পারে। এরকম পরিস্থিতিতে খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের ৩৮ দিন পর বসরার পূর্বাঞ্চলে ইরানি যোদ্ধারা ‘রমজান’ অভিযান শুরু করেন।  ইরানি কমান্ডাররা ইরাকি সেনাদের ভেঙে পড়া মনোবলকে কাজে লাগিয়ে রমজান অভিযানে ব্যাপক সাফল্য পাওয়ার আশা করেছিলেন। এজন্য তারা বসরা শহরের আশপাশে ইরাকি বাহিনীর সব স্থাপনা দখল করে এই শহর অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন।

ইরানের পক্ষ থেকে ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালানোর ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘ সরব হয় এবং এক বিবৃতি প্রকাশ করে উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে। জাতিসংঘ তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায় কিন্তু ইরান স্বাভাবিকভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করে।  উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ইরাকি বাহিনী ইরানের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে ফেলার সময় যে জাতিসংঘ মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল সেই জাতিসংঘ ‘রমজান’ অভিযান শুরু হওয়ার দু’দিনের মাথায় প্রস্তাব পাস করে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানায়।

ইরানের সেনাবাহিনী ও ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি চারটি ফ্রন্টে পাঁচ পর্যায়ে রমজান অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনায় বলা হয়, দু’দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে ইরাকের এক হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করতে হবে। কিন্তু ততদিনে ইরাকি সেনাবাহিনী বসরা নগরীর উত্তর-পশ্চিম অংশে ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও এক কিলোমিটার চওড়া এক বিশাল কৃত্রিম খাল খনন করে তাতে পানি পূর্ণ করে ফেলে। এরপর এই খালের বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ করার জন্য ভারী কামান ও গোলন্দাজ ইউনিট মোতায়েন করে। এছাড়া, এই খালের উত্তর অংশ দিয়ে তারা বড় বড় পাম্প স্থাপন করে সার্বক্ষণিকভাবে সেখানে পানি ফেলতে থাকে যাতে খালের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে পানি উপচে আরো বহু কিলোমিটার এলাকায় কৃত্রিম বন্যা সৃষ্টি হয়। ফলে ওই এলাকা দিয়েও যাতে ইরানি যোদ্ধাদের পক্ষে ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ না থাকে।

১৯৮০’র দশকের গোড়ার দিকে ১০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত বসরা নগরী ইরাকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত হতো। এই শহরে ছিল তেল শোধনাগার, বিশাল পেট্রোকেমিক্যাল কারখানা ও প্রাকৃতিক গ্যাস শোধন করার বেশ কয়েকটি ইউনিটসহ বহু শিল্প কারখানা। পাশাপাশি বসরার পশ্চিম পাশের বিশাল মরুভূমি এবং নগরীর উত্তর অংশের বিশাল জলাভূমি ছিল তেল সম্পদে সমৃদ্ধ। বাগদাদ-কুয়েত মহাসড়কটিও বসরার পাশ দিয়ে চলে গেছে। সাফওয়ান নামক এই মহাসড়ক দিয়ে ইরাকি বাহিনীর সব অস্ত্রসস্ত্র, রসদ ও গোলাবারুদের চালান আসত। ইরানি যোদ্ধারা খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করার আগ পর্যন্ত ইরাকি বাহিনী বসরাকে রক্ষা করার জন্য ততটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ঠিক এ কারণেই সাদ্দাম এর আগে ইরানের খোররামশাহরকে ‘বসরার চাবি’ উল্লেখ করে এটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য তার কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছিল।

ইরাকি স্বৈরশাসক খোররামশাহরের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার পর ইরানি যোদ্ধাদের সামরিক শক্তি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পায়। এ কারণে সে তার রণকৌশলে আমূল পরিবর্তন আনে। ইরাকে ইরানি যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ রোধ করতে সীমান্তে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। সাদ্দাম একথা উপলব্ধি করে যে, ইরান কৌশলগত বসরা নগরীকে টার্গেট করতে পারে, তাই সে এই নগরীর প্রতিরক্ষার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে।

ইরান যদি রমজান অভিযানে সফল হতো তাহলে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় তেহরানের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থানে থেকে কথা বলতে এবং ইরাককে ইরানের শর্তগুলো মেনে নিতে বাধ্য করা সম্ভব হতো। কিন্তু অভিযানের শুরুর দিকে কিছুটা সাফল্য অর্জিত হলেও দুঃখজনকভাবে প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্রের অভাব এবং অসহনীয় গরমের কারণে ইরানি যোদ্ধাদের অগ্রাভিযান মন্থর হয়ে পড়ে এবং ইরাকি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অজন ছাড়াই অভিযান শেষ করতে হয়।

তবে ইরান পূর্বঘোষিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারলেও ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করে একথার জানান দেয় যে, তেহরান তার অধিকার আদায় করতে বদ্ধপরিকর। এদিকে ইরানি কমান্ডাররাও বুঝতে পারেন, যুদ্ধের পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই বরং পুরোপুরি পাল্টে গেছে। কাজেই তাদেরকেও যুদ্ধের কৌশলে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। রমজান অভিযানে ইরাকের নবম সাঁজোয়া ডিভিশনের একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। এতে ইরাকি বাহিনীর ছয় হাজার ৪০০ সেনা হতাহত এবং এক হাজার ৩১৫ জন ইরাকি সেনা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। ইরাকিদের এক হাজার ৭৭টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।