ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৪৭): 'মুসলিম বিন আকিল’ অভিযান
আমরা ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানি যোদ্ধাদের চালানো ‘রমজান’ অভিযানে ইরানের অর্জন সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা আগের আলোচনার ধারাবাহিকতায় ইরানের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে চালানো ‘মুসলিম বিন আকিল’ অভিযান নিয়ে কথা বলব।
বিগত আসরগুলোতে আমরা বলেছি, ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করতে চেয়েছিল ইরান। এ লক্ষ্যে ইরানি যোদ্ধারা দজলা ও আরভান্দ নদী পার হয়ে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলীয় বসরা নগরী অভিমুখী মহাসড়কগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। এই অভিযানের মাধ্যমে ইরাকের পৃষ্ঠপোষক পাশ্চাত্যকে ইরান একথা বোঝাতে চেয়েছিল যে, তেহরান দখলদার ইরাকি বাহিনীকে নিজের ভূমি থেকে হটানোর পর এখন তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ে বদ্ধপরিকর। কিন্তু ওই অভিযানে ইরাকি বাহিনীর কিছু ক্ষতি হলেও সার্বিকভাবে অভিযানটি সফল হয়নি।
ওই অভিযান শেষে ইরান ও ইরাক বিগত দুই বছরের যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যার যার সামরিক শক্তিকে ঢেলে সাজায়। রমজান অভিযান শেষে এটা স্পষ্ট হয় যে, ইরাকি বাহিনী ইরান থেকে হটে যাওয়ার পর নিজের সামরিক শক্তিকে এতটা শক্তিশালী করে যাতে তাদেরকে কোনো অবস্থাতেই ইরাকের ভূমি হাতছাড়া করতে না হয়। ইরাকি সেনারা নিজেদের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি যুদ্ধে সময়ক্ষেপণের চেষ্টা করে যাতে ইরানি যোদ্ধাদের অগ্রাভিযান রোধ করা যায়। এ সময় ইরাকি সেনারা ইরান থেকে পিছু হটে নিজেদের সীমান্তে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল বলে তাদেরকে কম জায়গায় যুদ্ধ করতে হচ্ছিল। এ কারণে তাদের পক্ষে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রনয়ণের মাধ্যমে ইরানি যোদ্ধাদের মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছিল। শত্রুসেনারা কামানের গোলাবর্ষণের সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের সাঁজোয়া ইউনিটগুলোকে যুদ্ধে ব্যবহার করছিল।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, ইরাকি সেনারা স্থলপথে আর কোনো আগ্রাসন না চালিয়ে তাদের দেশরক্ষায় মনযোগী হয় এবং এ কাজে তাদের বিমান ও নৌ ইউনিটগুলোকে ব্যবহার করে। সেইসঙ্গে ইরানের ভূমিতে আবারো আগ্রাসন চালানোর চিন্তা মাথা থেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলেননি ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম। তিনি ইরাকের আর্টিলারি ডিভিশনকে শক্তিশালী করেন এবং রিজার্ভ সেনার সংখ্যা বাড়িয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন। সাদ্দাম এ সময় জেইশ-আশ-শাবি নামের গণবাহিনী গঠন করেন যার ফলে ইরাকি সেনাবাহিনীর যুদ্ধ করার সক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। ইরানের সম্ভাব্য অগ্রাভিযান প্রতিহত করার উদ্দেশে ইরাকি সেনারা তাদের ইঞ্জিয়ারিং কোরের সাহায্য নেয়।
বাগদাদ সরকার তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে অত্যাধুনিক ট্যাংক টি-৭২ গ্রহণ করে এবং ইরানের অভ্যন্তণে আগ্রাসন চালাতে গিয়ে ইরাকি বাহিনীর যেসব দুর্বলতা ধরা পড়েছিল তা সারিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। ফলে সাদ্দাম বাহিনী একটি সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত হয়।

এদিকে ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে রমজান অভিযান শেষ হওয়ার পর আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধে বাগদাদের পক্ষ অবলম্বনের কথা ঘোষণা করে। মার্কিন সরকার জানায়, তারা এ যুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য, স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি ও সামরিক পরামর্শ দিয়ে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে সহযোগিতা করছে। রমজান অভিযান শেষ হওয়ার পর ইরাকের প্রতি ব্যাপকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া দেশের কাতারে আমেরিকা একা ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নও সাদ্দাম সরকারকে কয়েকশ’ টি-৭২ ট্যাংক দেয়ার পর অত্যাধুনিক বোমারু বিমান মিগ-২৫ সরবরাহ করে। ওই সময় বিশ্বে এর চেয়ে আধুনিক কোনো যুদ্ধবিমান ছিল না।
রমজান অভিযান শেষ হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ইরানের আকাশে মিগ-২৫ যুদ্ধবিমান উড়তে দেখা যায়। আর এই বিমান হাতে পাওয়ার পর ইরাকি বিমান বাহিনীর যুদ্ধ ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যায়। এই জঙ্গিবিমান প্রতিহত করার প্রযুক্তি সে সময় ইরানের ছিল না বলে আগ্রাসী সেনারা এই বিমান নিয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানের আকাশ পর্যন্ত চলে আসে। এ ছাড়া, পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ইরানের খার্গ দ্বীপেও মিগ-২৫ দিয়ে হামলা চালায় ইরাকি বিমান বাহিনী। এ পর্যায়ে ইরাকের ভেতরে বসেই যুদ্ধকে ইরানের ভূমিতে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সাদ্দাম সরকার বিদেশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহে তৎপর হয়। মস্কো বাগদাদকে স্কাড-বি মডেলের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে যা দিয়ে ইরাকি সেনারা রাজধানী তেহরানসহ ইরানের বড় শহরগুলোতে হামলা করতে থাকে।
এদিকে রমজান অভিযানের পর ইরানও তার সামরিক শক্তিকে ঢেলে সাজায়। ওই অভিযানে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না আসায় ইরান ভিন্ন ফ্রন্টে এমন অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে নিজে কম ক্ষতির শিকার হয়ে শত্রুসেনাদের তুলানামূলক বেশি ক্ষতি করা যায়। রমজান অভিযান চালাতে গিয়ে ইরান বুঝতে পারে, সামনের দিকে যুদ্ধ চালাতে হলে পুরনো কৌশল বদলে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সেইসঙ্গে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী জনবল এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসস্ত্রেরও প্রয়োজন হবে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে এতসব বিষয় একসঙ্গে প্রস্তুত ছিল না। তাই শত্রুসেনাদেরকে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ না দেয়া ও যুদ্ধে ব্যস্ত রাখার জন্য ইরান সাময়িকভাবে ছোট কিছু অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ১৯৮২ সালের গ্রীষ্মের শেষদিকে ‘মুসলিম ইবনে আকিল’ নামের অভিযান চালানো হয়। প্রকৃতপক্ষে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইরানের পক্ষ থেকে চালানো প্রথম অভিযান ছিল ‘মুসলিম ইবনে আকিল’। ইরাকের মানদালি শহরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সবগুলো পাহাড় দখল করা ছিল এই অভিযানের উদ্দেশ্য। সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত এই পাহাড়গুলো ছিল ইরাকে প্রবেশের মুখে অনেক বড় বাধা। এসব পাহাড়ে অল্প কিছু সেনা রেখে দিয়ে সীমান্তের এই অংশ নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত ছিল শত্রু সেনারা। কাজেই পাহাড়গুলো দখল করতে পারলে পরবর্তীতে ইরাকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা ইরানি যোদ্ধাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে ভেবে এই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিষয়টি উপলব্ধি করে ইরাকি সেনারা যেকোনো মূল্যে এই অভিযানেও ইরানকে সফল হতে দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে ইরানের হাতে আটক একজন ইরাকি সেনা কমান্ডার জানায়: তারা ইরানের ওই অভিযান প্রতিহত করার লক্ষ্যে পাহাড়ি এলাকাটিতে ৫০ বলয়ের মাইন ও গোপন বিস্ফোরক স্থাপন করেছিল।
যাই হোক, রমজান অভিযান শেষ হওয়ার দুই মাস পর ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে ‘মুসলিম ইবনে আকিল’ অভিযান শুরু হয়। ইরাকি বাহিনী আগে থেকেই এই অভিযানের খবর পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তুমুল লড়াইয়ের পর ইরানি যোদ্ধারা ইরাকের মানদালি শহরের নিকটবর্তী পাহাড়গুলো দখল করতে সক্ষম হন। অভিযানে ইরানের প্রায় ১৫০ বর্গকিলোমিটার ভূমি পুনরুদ্ধার হয়। ইরাকি বাহিনীর প্রায় চার হাজার সেনা হতাহত হয় এবং তাদের ৭৯টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়। ইরানি যোদ্ধাদের হাতে আটক হয় ২৭৫ জন আগ্রাসী ইরাকি সেনা। ইরানি যোদ্ধারা এই অভিযানের সময় ইরাকি বাহিনীর সাতটি জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করতে সক্ষম হন। অভিযানে ইরানের প্রায় ৫০০ যোদ্ধা শহীদ ও আড়াই হাজার সৈন্য আহত হন। সার্বিকভাবে রমজান অভিযানের ব্যর্থতার পর ‘মুসলিম ইবনে আকিল’কে ইরানের জন্য সফল অভিযান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখান থেকে প্রমাণিত হয় ইরান এই যুদ্ধে আবার বিজয়ের ধারায় ফিরে যেতে সক্ষম।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।