ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১ ১৬:৩০ Asia/Dhaka

১৯৮৩ সালে দক্ষিণ ইরানের ফাক্কে এলাকায় চালানো প্রথম বড় ধরনের অভিযানটি ব্যর্থ হলে এর নাম দেয়া হয় প্রাথমিক ওয়ালফাজর অভিযান।

এই অভিযানে ইরাকের অভ্যন্তরে ঢুকতে গিয়ে ইরানি যোদ্ধারা অসংখ্য জটিল ও কঠিন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। তারা প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে অগ্রসর হওয়ার পর এমন কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন যা তারা কল্পনাও করতে পারেননি; কারণ ইরাকিরা এর আগে কখনো এই কৌশল অবলম্বন করেনি। তারা চার কিলোমিটার দীর্ঘ পথে বিভিন্ন ধরনের কাঁটাতারের বেড়া, ভূমি মাইন, বিদ্যুতায়িত জলাশয় এবং ড্রাম ভর্তি বিস্ফোরক রেখে দিয়েছিল যার ফলে ইরানি যোদ্ধাদের পক্ষে সামনে অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও ইরানের সাহসী বীর যোদ্ধারা এসব বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যান।

অভিযানে ইরাকের ৭০৪ ও ৯০৫ নম্বর ব্রিগেডের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করা ছাড়াও এক ব্যাটেলিয়ান সুদানি সেনার প্রায় সবাই নিহত হয়। সাদ্দাম বাহিনীর ১১৩ জন সেনা ইরানের হাতে বন্দি হয়। পাশাপাশি ইরাকিদের ৮০টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান, ১২০টি গাড়ি, বিপুল পরিমাণ হালকা ও ভারী অস্ত্র এবং পাঁচটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়। তাদের চার হাজার ৬২০ সেনা হতাহত কিংবা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। এতকিছুর পরও ইরান এ অভিযানে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।

এ কারণে ইরানি কমান্ডাররা পরবর্তী অভিযান এমন এলাকাগুলোতে চালানোর সিদ্ধান্ত নেন যেখানে ইরাকি বাহিনী শক্তিশালী অবস্থানে নেই। সেইসঙ্গে এমন সময় এলাকায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয় যেখানকার প্রকৃতি ইরানি যোদ্ধাদের জন্য সহায়ক এবং যেখানে অস্ত্রসস্ত্রের তুলনায় জনশক্তির ওপর বেশি নির্ভর করে অভিযান চালানো যায়।

সামেনুল আয়েম্মে থেকে শুরু করে ‘প্রাথমিক ওয়ালফাজর’ পর্যন্ত অভিযানে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বড় ধরনের অভিযানের পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু প্রাথমিক ওয়ালফাজর অভিযানে ব্যর্থতার কারণে পরবর্তী অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নে আইআরজিসি’র অবস্থান অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে ইরানের সেনাবাহিনী মনে করছিল তাদেরকে গণবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে তারা তাদের দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আইআরজিসি’র চেয়ে ভালো অভিযান পরিচালনা করতে পারবে। এ কারণে, এবার সিদ্ধান্ত হয় ওয়ালফাজর-১ অভিযানের পরিকল্পনা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে।

এর আগের বেশিরভাগ অভিযান রাতের অন্ধকারে এবং ইরাকি বাহিনীর বিশ্রামের সময় চালানো হলেও এবার সেনাবাহিনী অনেকটা ঘোষণা দিয়ে কামান ও ট্যাংকের গোলাবর্ষণের মাধ্যমে অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইরানি যোদ্ধারা অভিযানের শুরুতেই কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করেন এবং শত্রু সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে প্রায় ৬০ হাজার গোলা নিক্ষেপ করেন। ইরাকি বাহিনীও ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করে এবং তারা ইরানি অবস্থানগুলোতে প্রায় ১৫ লাখ গোলা নিক্ষেপ করে।  ইরাকি শাসক সাদ্দামের শক্তিশালী গোলন্দাজ বাহিনীর এই ভারী গোলাবর্ষণের কারণে ওয়ালফাজর-১ অভিযানে ইরানকে হার মানতে হয়। এই অভিযানে আইআরজিসি’র ৮০ ব্যাটেলিয়ান এবং সেনাবাহিনীর ৩০ ব্যাটেলিয়ান যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। অন্যদিকে ইরাকের পক্ষে নয় ডিভিশন, ১০ ব্রিগেড ও ১০ ব্যাটেলিয়ান সেনা অংশ নেয়। অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের ৪০০টি কামান থেকে অনবরত ইরানি সেনা অবস্থানে গোলাবর্ষণ চলতে থাকে।

ওয়ালফাজর-১ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল ইরাকের মিসান প্রদেশের কৌশলগত আল-আম্মারা শহর দখল করে উত্তর দিক থেকে ইরাকের বসরা নগরীকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়া। একইসঙ্গে কয়েকটি ইরাকি তেলক্ষেত্র নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পরিকল্পনাও ইরানি যোদ্ধাদের ছিল।

১৯৮৩ সালের ১০ এপ্রিল রাত ১০টা ১০ মিনিটে ওয়ালফাজর-১ অভিযান শুরু করা হয়। শুরু থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত অভিযান পরিকল্পনা মাফিকই এগুচ্ছিল। পরবর্তী ছয়দিন পর্যন্ত সেখানকার পার্বত্য অঞ্চলগুলো ইরান ও ইরাকি সৈন্যদের মধ্যে বারবার হাতবদল হয়। অভিযান শেষে ইরাকি বাহিনীর ছয় হাজার ৭৫০ জন সেনা হতাহত বা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয় এবং তাদের ৯৮টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়। অভিযানে হেমরিন পার্বত্য এলাকার একাংশ, ‘দুইরাজ’ নদীর তীরবর্তী কয়েকটি গ্রাম এবং সীমান্তবর্তী একটি সেনা ঘাঁটি শত্রুসেনা মুক্ত হয়। অর্থাৎ এই অভিযানে ইরানি যোদ্ধারা তাদের দেশের প্রায় ১৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখলদার সেনাদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।  কিন্তু এতসব সত্ত্বেও ওয়ালফাজর-১ অভিযানটি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। 

সাধারণভাবে ইরানের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হলে সাদ্দাম বাহিনী ইরানের সীমান্তবর্তী শহরগুলোর বেসামরিক অবস্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাত। ইরাকি সেনারা প্রথমেই যে শহরটিতে হামলা চালাত সেটি হচ্ছে ইরানের দেজফুল শহর। ওয়ালফাজর-১ অভিযান শেষ হওয়ার পর ১৯৮৩ সালের ২০ এপ্রিল বুধবার আগ্রাসী ইরাকি সেনারা দেজফুল শহর লক্ষ্য করে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এর ফলে নগরীর ৭০টি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়, ২০ ইরানি শহীদ এবং ১৫০ জন আহত হন। এর দু’দিন পর ইরাকিরা ১৯৮৩ সালের ২২ এপ্রিল শুক্রবার দেজফুল শহরে আবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এবারের হামলায় প্রায় ২০০টি বাড়ি ও দোকান ধ্বংস হয়। এবারের হামলায় অন্তত ২০ জন নিহত ও দুইশ জনের বেশি নিরীহ মানুষ আহত হন।

ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) দেজফুলের ওপর একের পর এক হামলার প্রতিক্রিয়ায় বলেন: আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারীদের বলতে চাই আপনারা এসে দেখে যান তারা আমাদের খুজিস্তান ও দেজফুল শহরের নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের সঙ্গে কি পাশবিক আচরণ করছে। ইরাকি শাসকগোষ্ঠী ভাবছে, তারা বেসামরিক অবস্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে নিরপরাধ নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করে আমাদেরকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করতে পারবে। কিন্তু আমি বলতে চাই, তারা খুজিস্তানকে চিনতে পারেনি, দেজফুলকে চিনতে পারেনি। তারা যদিও যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বারবার এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যে, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে এবং বেসামরিক নাগরিকদের শহীদ করে এদেশের জনগণের প্রতিরোধে ফাটল সৃষ্টি করতে পারছে না, তারপরও তারা এ ধরনের বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের জনগণ বিশেষ করে দেজফুলের জনগণ ‘বিজয় অর্জন পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে’ বলে স্লোগান দিচ্ছি এবং এই স্লোগান অব্যাহত থাকবে। #                                                                                                                                                                                                                                     

 

 

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।