মার্চ ০৮, ২০২১ ২২:১১ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছো। সপ্তাহ ঘুরে আবারো তোমাদের মাঝে হাজির হয়েছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

আকতার জাহান: বন্ধুরা, শরীরের সুস্থতার জন্য পরিশ্রম তথা কাজের গুরুত্ব যে অনেক বেশি- তা নিশ্চয়ই তোমরা স্বীকার করবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে শ্রম দেয়, কষ্ট করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদকারী মুজাহিদের মতো।"

গাজী আবদুর রশিদ: অন্যদিকে, ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, “মানুষের সকল প্রয়োজনীয়তা যদি কোনোরকম কাজকর্ম ছাড়াই পূরণ হয়ে যেত তাহলে কক্ষণো তাদের জীবন স্বাস্থ্যকর হতো না এবং জীবন উপভোগ্য হয়ে উঠত না।"

আকতার জাহান: ‘সভ্যতার ইতিহাস' নামক গ্রন্থের লেখক বিল ডুরান্ট বলেছেন, “সুস্থতা কাজের মাঝে নিহিত। মানব জীবনের সুখ সমৃদ্ধি আর সন্তুষ্টির মূল রহস্যগুলোর একটি হলো কাজ।”

গাজী আবদুর রশিদ: অন্যদিকে, বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও কবি ফ্রাঁসোয়া ভলতেয়ার বলেছেন, “যখনি অনুভব করি কষ্ট, ক্লান্তি আর রোগব্যাধি আমাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে তখন কাজের আশ্রয় নিই, কেননা আমার ভেতরের যন্ত্রণার সবচেয়ে উত্তম প্রতিষেধক হচ্ছে কাজ।”

আকতার জাহান: মূলত জীবনকে সুন্দর করার জন্যই ইসলাম ধর্মে কাজের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং অলসতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যে নিজ হাতে রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করে, সেই হাতকে বলা হয়েছে শ্রেষ্ঠ। আর অলস মস্তিষ্ককে বলা হয়েছে 'শয়তানের আখড়া'।     

গাজী আবদুর রশিদ: যুগে যুগে যারাই বড় বড় সভ্যতার জন্ম দিয়েছেন তারা নিরলস পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁরা নিজেদের খোদাপ্রদত্ত মেধাকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতে অনন্য অবদান রেখে গেছেন।

আকতার জাহান: তো বন্ধুরা, বড় হওয়ার জন্য, আদর্শ মানুষ হওয়ার জন্য এবং সুনাম অর্জনের জন্য তোমরা সবাই কর্মঠ ও উদ্যমী হবে- এ প্রত্যাশায় শুরু করছি রংধনুর আজকের আসর। আসরের শুরুতেই আমরা এক 'অলস ব্যক্তির গাছকাটা' সম্পর্কে একটি গল্প শোনাব।

গাজী আবদুর রশিদ: আর গল্প শেষে থাকবে বাংলাদেশের এক ছোট্টবন্ধুর কণ্ঠে একটি গান ও কবিতা। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তো প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

আকতার জাহান: অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক অলস লোক তার জীবনের সব কাজেই অলসতা করত। কোনো কাজেই সে সিরিয়াস ছিল না। আজ যে কাজটি করে ফেলা যায় সে কাজটিও ফেলে রাখত ভবিষ্যতের জন্য। আর আগামি দিনের কাজ তো ফেলে রাখত অনাদিকালের জন্য।

গাজী আবদুর রশিদ: লোকটি এতই অলস ছিল যে, ছোটখাট কাজও-যেটা যখন তখন করে ফেলা সম্ভব কিংবা করাটা খুব একটা কষ্টেরও নয়- তাও সে করত না। মনে মনে বলত: "ধুর ছাই! রাখো তো। যত্তোসব ছাইপাঁশ। বহু সময় পড়ে আছে, এখনই করার দরকার নেই- পরে দেখা যাবে।"

আকতার জাহান: এভাবে ছোট ছোট কাজ দিনের পর দিন জমে যেতে যেতে বিরাট ঝামেলা তৈরি হয়ে যেত। ওই ছোট কাজগুলোই কোন্‌টা রেখে কোন্‌টা করবে- এরকম সমস্যায় পড়ে যেতে হতো।

গাজী আবদুর রশিদ: এই অলস লোকের ঘরের পাশেই বেড়ে উঠেছিল এক গাছ। গাছটি সে নিজেই লাগিয়েছিল। গাছে কাঁটা ভরা। বড় বড় কাঁটা। গোড়া থেকে একেবারে আগা পর্যন্ত প্রতিটি শাখায় শাখায় বড় বড় কাঁটা পেরেকের মতো বের হয়ে ছিল।  কাঁটাগুলো বেশ ধারাল।

আকতার জাহান: গাছটির আর কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না। না ছিল ফল ফুল, না ছিল সুবাস-গন্ধ, আর না ছিল পত্-পল্লব। কেবল কাঁটাই সার।

গাজী আবদুর রশিদ: ঘরের পাশে গাছটি বেড়ে উঠলেও জনগণের চলাচলের পথেই পড়েছিল কাঁটাগাছ। তাই প্রতিদিনই বহু মানুষ এই কাঁটাগাছের পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করত। আনমনা ছিল যারা স্বাভাবিকভাবেই তাদের গায়ে এই গাছের কাঁটা বিদ্ধ হতো। মানুষ তাই খুবই বিরক্ত হতো, কষ্ট হতো তাদের এই কাঁটা গাছটির জন্য। পথচলার সময় বাতাসে গায়ের জামা উড়ে গিয়ে কাঁটায় বিঁধে যেত। টানতেই ছিঁড়ে যেত সেই জামা।

আকতার জাহান: পথচারীরা প্রত্যেক দিন ওই অলস লোকটিকে বলত সে যেন এই অপ্রয়োজনীয় কাঁটা গাছটি তার ঘরের দরোজা থেকে তুলে নেয়। কেননা এই গাছটির কোনো ব্যবহারও নেই। অলস লোকটি তাদের কথার জবাবে বলত: ‘ঠিক আছে। কাল অবশ্যই ওই কাঁটা গাছটাকে শেকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে দেব’।

গাজী আবদুর রশিদ: কিন্তু গাছ গাছের জায়গায়ই থেকে যেত। তার গায়ে হাতও লাগাত না অলস। এভাবে গাছটি আরও মোটা তাজা এবং লম্বা হয়ে উঠল। পাল্লা দিয়ে অলস থেকে অলসতর হয়ে উঠল আমাদের গল্পের অলস লোকটিও।

আকতার জাহান: দিনের পর দিন এভাবে যেতে যেতে কাঁটা গাছটি আরও সারি হয়ে উঠল। এতোই শক্ত এবং মজবুত হয়ে উঠল যে, এখন আর অলসের পক্ষে ওই গাছটি শেকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলা তো দূরের কথা গোড়া কেটে ফেলার মতো সাধ্যের মাঝেও আর রইল না। লোকজন এখন অলস লোকটিকে বলতে লাগল: 'এই অপদার্থ কাঁটা গাছটি যদি শিগগিরি আমাদের চলাচলের পথ থেকে সরানো না হয় তাহলে আমরা নগরপতির কাছে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ দেব।'

গাজী আবদুর রশিদ: তারপরও তার কোনো হুঁশ হলো না। অবশেষে লোকজন ঠিকই তার বিরুদ্ধে শহরের মেয়রের কাছে অভিযোগ দিল। মেয়র যথারীতি তাকে হাজির করার আদেশ দিল।

আকতার জাহান: নগরপতি অলস লোকটাকে বলল: 'এই অলসের হাড্ডি! তোর আলসেমির কথা সারা শহরের মানুষের মুখে মুখে। তুই তোর ঘরের সামনে থেকে কাঁটাগাছটাকে সরাচ্ছিস না কেন? কেন ওই কাঁটাগাছ দিয়ে জনগণকে কষ্ট দিচ্ছিস? তুই কি দেখতে পাস না প্রতিদিনই কেউ না কেউ ওই গাছের কাঁটায় আহত হয় কিংবা কারো না কারো জামা কাপড় ছিঁড়ে যায়? মানুষজন যে এতো করে তোকে বলল তুই তাদের কথায় কান দিচ্ছিস না কেন? কেন এখনো গাছটা কেটে ফেলছিস না?'

গাজী আবদুর রশিদ: অলস লোকটি বলল: ‘আমি তো সকলকেই বলেছি- যে-ই আমার কাছে অভিযোগ করেছে তাকেই বলেছি- শিগগিরি আমি গাছটা কেটে ফেলব।’

আকতার জাহান: নগরপতি বলল: 'কিন্তু লোকজন তো বলছে বহুদিন ধরেই তারা তোকে এই গাছটা কেটে ফেলার জন্য বলে আসছে আর তুই কাল পরশু করে করে এ পর্যন্তও গাছটা কাটিস নি। সেই ছোট্ট থাকতেই লোকজন তোকে বলেছিল আর আজ গাছটা মোটা তাজা হয়ে বিশাল আকার ধারণ করেছে।'

গাজী আবদুর রশিদ: অলস লোকটা বলল: ‘ঠিকই বলছেন। আর এমনটি হবে না। কালই আমি গাছটা কেটে ফেলব।’

আকতার জাহান: নগরপতি হাসলেন। এরপর বললেন: 'অলসতা বাদ দে। কাল কেন? আজই কাজটা সেরে ফেল যাতে মানুষ একটু স্বস্তি পায়, হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারে। তোকে আমি একটা পরামর্শ দেই। এটাকে উপদেশ হিসেবেও নিতে পারিস। সেটা হলো, তোর জীবনের সকল কাজের ক্ষেত্রে ‘কাল পরশু’ করব-এই অভ্যাস বাদ দে। মনোযোগ দিয়ে শোন। কক্ষণো ছোট হোক কিংবা বড় হোক কোনো কাজকেই আগামিকালের জন্য রেখে দিবি না। যে কাজটা এই মুহূর্তেই করে ফেলা সম্ভব সে কাজ ‘পরে করব’ এরকম চিন্তা করবি না। সুতরাং এক্ষুণি যা, ওই কাঁটাগাছটা কেটে ফেল।’

গাজী আবদুর রশিদ: নগরপতির কাছে যে কয়জন এসেছিল অলসের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে তারা অলস লোকটা ‘পরে, কাল, পরশু’ ইত্যাদি উপহাসমূলক শব্দ শুনিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতে লাগল। একজন বলল: 'এই লোককে আমি ভালো করেই চিনি, ও কোনোদিনও ঠিক হবে না। সে একা এই গাছ কাটতেও পারবে না। আমাদের উচিত সবাই তাকে সাহায্য করা এবং সবাই মিলে গাছটা কেটে ফেলা। গাছটার গোড়া উপড়ে ফেলে একেবারে পুড়ে ফেলা উচিত।'

আকতার জাহান: একথা শুনে অলস লোকটি বিরক্ত হলো। বলল: 'তোমরা আমাকে নিয়ে মশকরা করছ! আমি একা পারব না গাছটা কাটতে! এক্ষুণি আমি দেখাচ্ছি একা কী করে কাটা যায়।'

গাজী আবদুর রশিদ: এই বলে অলস লোকটি ঘরে গেল। একটা কুঠার নিয়ে গাছের গোড়ায় কোপাতে লাগল। কিন্তু কিছুক্ষণ কুপিয়ে সে বুঝতে পারল আসলেই একার পক্ষে গাছটা কাটা সম্ভব নয়। লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে গাছের গোড়া। কুড়াল ফিরে আসে, কাটে না। তার মাথা থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়তে লাগল।

আকতার জাহান: কিন্তু সে থামল না, কুঠার চালাতে লাগল। অবশেষে ঠিকই সে সফল হলো। কেটে ফেলল গাছটি। এখন বাকি রইল গাছের শেকড়শুদ্ধ গোড়া। এটা সত্যিই কঠিন কাজ। একা সে পারছিল না। হঠাৎ দেখা গেল আশেপাশের প্রতিবেশিরা এগিয়ে এল কুঠার শাবল হাতে নিয়ে। তারা বলল: 'তুমি গাছ কেটেছ, অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। এবার আমরা শেকড় তুলব।'

গাজী আবদুর রশিদ: এই বলে শুরু করে দিল সবাই। সকলের চেষ্টায় শেকড় তোলা হলো এবং শেকড় পুড়িয়ে ফেলল। এরপর থেকে লোকজন নিশ্চিন্ত মনে ওই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করতে লাগল। কাউকেই আর কাঁটায় আহত হতে হলো না কিংবা কারও জামা কাপড়ও আর কাঁটায় ছিঁড়তে হলো না।

আকতার জাহান: বন্ধুরা, দেখলে তো অলস লোকটি আলস্য ছেড়ে কাঁটাগাছটি কেটে ফেলার ফলে পথচারীদের কেমন সুবিধা হলো! তোমরাও অলসতা ঝেড়ে ফেলে সংসারের ছোটখাট কাজ ও পড়াশোনায় এখন থেকে গভীর মনোযোগ দেবে কেমন? আর তাহলেই তোমার ভবিষ্যৎ হবে সুন্দর ও চিন্তামুক্ত।

গাজী আবদুর রশিদ: বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে তোমাদের জন্য রয়েছে একটি কবিতা। কবি আহসান হাবীবের লেখা ‘ইচ্ছা’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছে ঢাকার সারেগামা একাডেমির সদস্য মাসরুরা মাহনূর সুহা।

আকতার জাহান: চমৎকার একটি আবৃত্তি শুনলেন। বন্ধুরা, আবৃত্তির পর এবার আমরা সুহার কণ্ঠে একটি গান শুনব। ‘প্রত্যাশা’ শিরোনামের গানটির কথা ও সুর মাহফুজ বিল্লাহ শাহী’র। 

গাজী আবদুর রশিদ: তো বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে।

আকতার জাহান: কথা হবে আবারো আগামী আসরে। 

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।