মার্চ ১৫, ২০২১ ১৬:৩০ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বের আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি নিখিল বিশ্বের সৃষ্টি ও এর স্থিতি, স্থায়িত্ব, ক্রমবিকাশ, ক্রমোন্নতি, ধ্বংস, প্রলয়, পুনরুত্থান ও পুনর্গঠন- জীবন দেয়া ও জীবন নেয়া – এ-সবই মহান আল্লাহরই মহাশক্তির প্রকাশ যা প্রকাশ করে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নামের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য।

পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল খালিক্ব। এই নামের অর্থ সৃষ্টিকর্তা বা স্রষ্টা। মহান আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম হিসেবে এ শব্দটি এসেছে সুরা হাশরের ২৪ নম্বর আয়াতে। এই আয়াতের অর্থ হল: তিনিই আল্লাহ তা’আলা, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, রূপদাতা, উত্তম নামসমূহ তাঁরই। নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।

সুরা যুমারের ৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ সর্বকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর অভিভাবক বা সবকিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। - এ আয়াতে মহান আল্লাহ সৃষ্টির বিষয় ও সব কিছুর অস্তিত্ব দেয়াকে তাঁর খালিক্ব নামের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন। অন্য কথায় মহান আল্লাহ তাঁর খালিক্ব নামের মাধ্যমে সব কিছু সৃষ্টি করেন।

খালিক্ব শব্দের মূল ব্যুৎপত্তিগত বা উৎসগত অর্থ হল পরিমাপ এবং ওজন। যিনি কোনো কিছু সৃষ্টি করেন তিনি এর প্রকৌশলও জানেন। যিনি একটি ভবন নির্মাণ করেন তিনি জানেন যে কোন ধরনের কক্ষ কোথায় থাকবে, কোথায় থাকবে বারান্দা, করিডোর, দরজা, জানালা এবং এসবের পরিমাপ ও বিস্তারিত নানা দিক -এসব কিছু ঠিক রেখেই ও যথাযথ মাত্রায় রড-সিমেন্ট-বালু প্রভৃতি ব্যবহার করে তিনি নির্মাণ করেন ভবন। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ সুরা ক্বামার-এর ৪৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন, আমি প্রত্যেক বস্তুকে পরিমিতরূপে তথা উপযুক্ত রূপে ও গঠনে সৃষ্টি করেছি।

স্রস্টাকে সব কিছু সৃষ্টির ক্ষেত্রে যথাযথ মাপ ও পরিমাপ বজায় রাখতে হয়। এ বিশ্ব জগতের গ্রহ-নক্ষত্র থেকে শুরু করে মানব দেহের ও অন্য সব জীবের প্রতিটি কোষ এবং প্রত্যেক বস্তুর অণু-পরমাণু, ইলেকট্রন, প্রোটন -এসবই যথাযথ পরিমাপে ও সুনির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় সুসমন্বয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই এত বেশি নিয়মের রাজত্ব যে জ্যোতির্বিদ বা মহাকাশবিদরাও সুনির্দিষ্ট সূত্রের ভিত্তিতে ঘটনা ঘটার বহু বছর আগেই বলে দিতে পারছেন যে কবে পূর্ণ সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্র গ্রহণ হবে এবং কবে সেসব আংশিকভাবে হবে।

ছোটো ছোটো পিপড়ার জটিল দেহের গঠন, স্নায়ু ও সূক্ষ্ম রগ বা শিরা-উপশিরার মধ্যে সমন্বয় মহা-বিস্ময়কর।  সুরা মুল্‌ক্‌-এর তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতে মহান আল্লাহ সবাইকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলছেন, করুণাময় আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি বা খুঁত পাবে না তোমরা। আবার তাকিয়ে দেখো কোনো ত্রুটি দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বার বার তাকিয়ে দেখো-তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে। 

মহান আল্লাহ শ্রেষ্ঠ সুক্ষ্মদর্শী স্রস্টা। মহান আল্লাহর সূক্ষ্মতার পরিমাপের ও সমন্বয়ের নিদর্শন দেখে বিজ্ঞানীরা খেই হারিয়ে ফেলেন। এক মিলিমিটারের লক্ষ-কোটি ভগ্নাংশের চেয়েও ক্ষুদ্র বা সূক্ষ্ম বিষয় বা উপাদান যা মানুষের কল্পনায়ও স্থান পায় না তা মহান আল্লাহর নানা সৃষ্টির মধ্যে কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুধু পরিমাপগত বিষয়ই নয় গুণগত বিষয়েও মহান আল্লাহ শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয় সুক্ষ্মদর্শী।  মহান আল্লাহর মহাপ্রজ্ঞা ও  অনন্য শৈল্পিক নৈপুন্যেরও সাক্ষ্য বহন করে নানা ধরনের সুন্দর ও সূক্ষ্ম সৃষ্টিকুল। মানুষের আত্মিক ও মানসিক ব্যবস্থাপনায়ও মহান আল্লাহ এমনসব সূক্ষ্ম পরিমাপগত ও গুণগত বিধান দিয়ে রেখেছেন যে সেসবের বিন্দুমাত্র স্বল্পতা বা বিচ্যুতি ব্যক্তি ও সমাজ-জীবনকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। কোনো ব্যক্তির মানসিক অবস্থার প্রতি বিন্দুমাত্র উদাসীনতা অথবা দরকারের চেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। তাই পরিমাপের মধ্যে সঙ্গতি ও সমন্বয় খুবই জরুরি।

 যিনি কোনো জিনিসের স্রস্টা তাকে ওই বিষয় সম্পর্কিত বিধি-বিধান বা ধর্মের প্রকৌশলও গড়ে তুলতে হয়েছে। স্থান ও সময়গত পরিমিতি দেয়ার পর ওই বস্তু গড়েন স্রস্টা। মহান আল্লাহ সৃষ্টিকুলকে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। সুরা মুমিনুনের ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,  'আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দু রূপে এক সংরক্ষিত আধারে তথা মাতৃগর্ভে স্থাপন করেছি। এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে চর্বিত মাংসপিণ্ডের মত বস্তুতে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিণ্ড থেকে অস্থিপঞ্জর সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিপঞ্জরকে করেছি আবৃত মাংস দিয়ে , অবশেষে তাকে নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত প্রাচুর্যময় বা কল্যাণময়।'

সুরা হুদের ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: তিনিই আসমান ও জমিন ছয় দিনে বা ছয় যুগে তৈরি করেছেন।-  মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে এক দিনেই সৃষ্টি করতে পারতেন এইসব। কিন্তু বস্তুজগতকে মহান আল্লাহ উপকরণ ও কার্যকারণের ফলাফলের বিধান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ এই বিধানকেই বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন।

প্রকৃত খালিক্ব বা স্রস্টা তাকেই বলে যিনি সম্পূর্ণ নতুন কিছু তৈরি করেন যার কোনো নজিরই অতীতে ছিল না। কেউ একটি গাড়ি তৈরি করার পর অন্য কেউ হুবহু অনুরূপ গাড়ি নির্মাণ করলে পরবর্তী ব্যক্তিকে নয় বরং প্রথম গাড়ির নির্মাতাকেই বলা হবে ওই গাড়ির স্রস্টা। মহান আল্লাহ মানুষ জাতি সৃষ্টি করেছেন এমনভাবে যে তাদের কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গেও অন্য ব্যক্তির পুরোপুরি মিল নেই। যেমন, এখন পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তাদের কারো আঙুল বা হাতের রেখা হুবহু এক রকম হয়নি। আর এ জন্যই হাতের আঙুলের ছাপ মানুষ শনাক্ত করার এক আদর্শ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বে হুবহু একই রকম দুটি গাছ ও দুটি পাথরও পাওয়া যাবে না! তাই আল্লাহই একমাত্র প্রকৃত স্রস্টা। বিশাল অস্তিত্বের জগত ও সৃষ্টি জগত একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। 

মহান আল্লাহ কত লক্ষ কোটি ছায়াপথ ও সৌরজগত সৃষ্টি করে রেখেছেন কে জানে! এমন অনেক গ্রহ-নক্ষত্র ও ছায়াপথ রয়েছে যা পৃথিবী থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন কোটি আলোক-বর্ষ দূরে অবস্থিত। তবে মানুষ হচ্ছে মহান আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা আশরাফুল মখলুকাত। মানুষের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর রুহ থেকে ফুঁকে দেয়া রুহ বা আত্মিক বস্তু।

অন্যদিকে স্রস্টা নাম দিয়ে অনেক মানুষ যেসব মূর্তি বা দেবতার পূজা করছে সেইসব দেবতার সবাই এবং সব মানুষ ও বিজ্ঞানী মিলেও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। আর মাছি যদি তাদের থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয় তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না,   এইসব প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে একটি নগণ্য মাছির মস্তিষ্ক ও তার শরীরের অন্য অনেক কিছুর গঠনও আধুনিকতম বিমানের চেয়েও অনেক জটিল ও উন্নত। বরং মাছির সঙ্গে তুলনারও যোগ্য নয় এই বিমান।

মাছির অনেক চোখ রয়েছে ও তা নানা দিকে লক্ষ্য রাখতে সক্ষম। বলা হয় মাছির রয়েছে এমন দুটি যৌগিক চোখ যা গঠিত হয়েছে তিন থেকে ছয় হাজার সাধারণ চোখ নিয়ে! এ ছাড়াও ওই দুই চোখের মধ্যবর্তী স্থানে মাছির রয়েছে আরও তিনটি চোখ যা অ্যান্টেনা বা রাডারের কাজ করে!#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।