মার্চ ১৭, ২০২১ ১৭:১০ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বের আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি নিখিল বিশ্বের সৃষ্টি ও এর স্থিতি, স্থায়িত্ব, ক্রমবিকাশ, ক্রমোন্নতি, ধ্বংস, প্রলয়, পুনরুত্থান ও পুনর্গঠন- জীবন দেয়া ও জীবন নেয়া – এ-সবই মহান আল্লাহরই মহাশক্তির প্রকাশ যা প্রকাশ করে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নামের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য।

পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল 'বারিউ' (বারিয়ু)। এ শব্দের অর্থ পৃথককারী বা উদ্ভাবক। পবিত্র কুরআনে এ শব্দটি চার বার এসেছে। মহান আল্লাহ বারিয়ু। কারণ তিনি সৃষ্টিকুলকে অস্তিত্বহীনতা থেকে পৃথক করেন। মহান আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম হিসেবে এ শব্দটি এসেছে সুরা হাশরের ২৪ নম্বর আয়াতে খালিক্ব শব্দটির পরই। এই আয়াতের অর্থ হল: তিনিই আল্লাহ তা’আলা, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, রূপদাতা, উত্তম নামসমূহ তাঁরই। নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।

যিনি উদ্ভাবক তিনি যা উদ্ভাবন করেন তাতে অতীতের কোনো কিছু বা বস্তু থাকে না। অর্থাৎ উদ্ভাবিত কিছুতে অতীতে পাওয়া যেত এমন কোনো উপাদান যেমন, পানি, মাটি, আগুন ও বাতাসের মত কিছুই নেই। কিন্তু যিনি খালিক্ব বা স্রস্টা  তিনি সৃষ্টির সময় অতীতে পাওয়া যেত এমন কিছুও ব্যবহার করেন। যেমন, মহান আল্লাহ মানুষকে কাদা-মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ একাধারে উদ্ভাবক ও স্রস্টা।

মহান আল্লাহ সম্পূর্ণ শূন্য বা অনস্তিত্ব থেকে সৃষ্টি করেছেন অনেক কিছু এবং মহান আল্লাহর উদ্ভাবন সব ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত।  তাই মহান আল্লাহর উদ্ভাবন ও সৃষ্টি ত্রুটি-বিচ্যুতি মুক্ত। মহান আল্লাহর সৃষ্টিগুলো সুনিয়ন্ত্রিত, সমন্বিত ও বিধিবদ্ধ এবং লক্ষ্য-কেন্দ্রিক। মহান আল্লাহ তার সৃষ্টিগুলোর অস্তিত্ব অব্যাহত রাখতে সেসবের মধ্যেই সৃষ্টিগুলোর সব চাহিদা লুকিয়ে রেখেছেন এবং এ জন্য সব পথ খোলা রেখেছেন।

 সুরা হাশরে স্রস্টা নামের পর উদ্ভাবক নাম তথা মহান আল্লাহর খালিক্ব নামটির পর বারিয়ু নামটি আসায় বোঝা যায় যে এ দুই নামের মধ্যে যৌক্তিক ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। মহান আল্লাহ স্রস্টা কারণ তিনি সৃষ্ট বস্তুর মাত্রা ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেন এবং সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষকে তিনি অস্তিত্বহীনতা ও ত্রুটিহীনতা থেকে মুক্ত রেখে পূর্ণতার মধ্যে পৌঁছান বলে তিনি বারিউ। অন্য কথায় বারিউ অর্থ প্রজ্ঞাময়, বিধিবদ্ধ ও লক্ষ্যপূর্ণ সৃজন যা মানুষকে পূর্ণতার পথে এগিয়ে নেয়।

মহান আল্লাহর বারিউ নামটি সুরা বাকারার ৫৪ নম্বর আয়াতে দুই বার এসেছে। হযরত মুসা (আ) যখন মহান আল্লাহর নির্দেশনা নেয়ার জন্য তুর পাহাড়ে যান ৪০ দিনের জন্য তখন বনি ইসরাইল গো-বৎসের পূজা শুরু করে। সুরা বাকারার  ৫১ থেকে ৫৩ নম্বর আয়াতে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরের অর্থাৎ ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: (ইকো) 'আর যখন মূসা তাঁর সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা তোমাদেরই ক্ষতিসাধন করেছ এই গো-বৎসের পূজা করে। কাজেই এখন তওবা কর নিজ স্রষ্টার কাছে এবং নিজ নিজ প্রাণ বিসর্জন দাও। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর তোমাদের স্রষ্টার কাছে। তারপর তোমাদের প্রতি লক্ষ্য করা হল। নিঃসন্দেহে তিনিই ক্ষমাকারী, অত্যন্ত মেহেরবান।

পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাকারীদের অনেকেই মনে করেন এখানে বলা হচ্ছে যে মহান আল্লাহ বনি ইসরাইলকে পবিত্র ও ত্রুটিহীনভাবে তথা বারিয়ু হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং খোদা-প্রদত্ত সহজাত নুরের মাধ্যমে তাদেরকে বিশ্বজগতের বাস্তবতার জ্ঞান দান করেছেন। ফলে তারা আসল ও নকলের পার্থক্য করতে শিখেছে ও নকল কিছুর ইবাদত থেকে দূরে থেকেছিল । কিন্তু তারা এমন মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে গোবৎসের পূজায় লিপ্ত হল। এই পূজা তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়েছে। ফলে খোদার কাছ থেকে পাওয়া তাদের পবিত্র সহজাত প্রকৃতি ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়েছে। ইরানের প্রখ্যাত দার্শনিক, আরেফ ও মুফাসসিরে কুরআন আয়াতুল্লাহ জাওয়াদ অমোলি'র মতে সুরা বাকারার ৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহর বারিউ নাম উল্লেখ করে যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা হল মহান আল্লাহ হলেন জ্ঞানী, শক্তিমান ও প্রজ্ঞাময় যিনি সৃষ্টিকুল সৃষ্টি করেছেন বিশেষ মাত্রায় এবং বিশেষ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থার আলোকে। তিনি প্রত্যেক সৃষ্টিকে কিছু বিশেষ লক্ষ্য ও কল্যাণের সঙ্গে সমন্বিত করেছেন।  তাই অজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত গাভী ও গো-বৎসের তুলনায় মহান আল্লাহই ইবাদত বা উপাসনা পাওয়ার বেশি যোগ্য বলে আয়াতুল্লাহ জাওয়াদ অমুলি পবিত্র কুরআন বিষয়ে তার লেখা তাফসির গ্রন্থ তাসনিম-এ উল্লেখ করেছেন।

আয়াতুল্লাহ জাওয়াদ অমুলির মতে যারা গো-বৎসকে প্রজ্ঞাময় মহান আল্লাহ'র সমকক্ষ বলে মনে করে তাদের মূল প্রকৃতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সুরা বাকারার  ৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহর অন্যতম নাম বারিয়ু'র উপস্থিতি সৃষ্টিকুলকে বিশেষ প্রজ্ঞাময়তা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের আলোকে সৃষ্টি করার বিষয়টি তুলে ধরে। কারণ মহান আল্লাহ নানা ধরনের কাঁচামাল সৃষ্টির পরই সেসবকে সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এরপর প্রকৌশল ও পরিমাপের মাধ্যমে এবং বিধিবদ্ধ করে সেসবের ভেতরটাকে আশপাশের সঙ্গে বা পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সমন্বিত করেছেন। আর মহান আল্লাহ এইসব কাজ করেন বলেই বারিয়ু নামের অধিকারী হয়েছেন।

সুরা আরাফের ১৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: সুন্দর নামগুলো মহান আল্লাহরই। তাই সুন্দর ও কল্যাণকর এইসব নাম দিয়ে বা আসমায়ুল হুসনার নামগুলোর মাধ্যমেই তাঁকে ডাকো বা আহ্বান কর।

আমাদের জীবনেও মহান আল্লাহর এইসব নাম বা গুণের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। মহান আল্লাহ বারিয়ু হিসেবে সর্বোত্তম স্রস্টা এবং সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে নিপুণ। তিনি যথাযথ পরিমাপ, সূক্ষ্মদর্শিতা ও সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা নিয়ে নানা উপাদান ব্যবহার করেছেন। এইসব উপাদান সব ধরনের অপূর্ণতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে মুক্ত।

মহান আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি বা আশরাফুল মাখলুক্বাত ও প্রতিনিধি হিসেবে মানুষেরও উচিত নিজ নিজ পেশায় ও কাজে সর্বোত্তম কাঠামো ও সর্বোত্তম উপাদানগুলো ব্যবহার করা এবং কাজের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেয়া ও কম কাজ করা থেকে দূরে থাকা।

মহান আল্লাহর বারিউ বা বারিয়ু নাম তাঁর খালিক্ব ও সালাম নামের মাঝামাঝি পর্যায়ের। সালাম অর্থ শান্তি, কল্যাণ ও সুরক্ষা। তাই তিনি সব ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে পবিত্র বা বারিয়ু। তিনি এমন চরম বা নিরেট ও নিরঙ্কুশ কল্যাণময় যে তাঁর মধ্যে নেই কোনো অকল্যাণ বা মন্দ। মহান আল্লাহ তাঁর দাসদের সঙ্গে এই সালামের আচরণই করেন যুদ্ধময় বা ক্ষতিকর কোনো আচরণ তিনি তাদের সঙ্গে করেন না। তাই প্রখ্যাত আরেফ মহিউদ্দিন আরাবির লেখা আসমাউল হুসনার অর্থ আবিষ্কার শীর্ষক বইয়ের ভাষ্য মতে, খোদা-প্রেমিক দাস নিজ চরিত্রের জন্য আল্লাহর খালিক্ব বা স্রস্টা নামের ও সালাম নামের মুখাপেক্ষী যাতে সব ধরনের ত্রুটি ও বিচ্যুতি থেকে মুক্ত থাকতে পারে।  আর এ দুই নামের মাধ্যমেই সে বারিয়ু নামে উপনীত হয়। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।