মার্চ ২৭, ২০২১ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম মুসাওয়িরু। এ নামের অর্থ রূপদাতা বা অঙ্কনকারী। অস্তিত্বের জগত মহান আল্লাহর খালিক্ব নামের আলোকে সুনির্দিষ্ট মাপে ও প্রকৌশলে এবং বারিয়ু বা উদ্ভাবক নামের আলোকে গড়ে উঠেছে।

মহান আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম হিসেবে মুসাওয়ির শব্দটি এসেছে সুরা হাশরের ২৪ নম্বর আয়াতে খালিক্ব ও বারিয়ু নামের পরই। এই আয়াতের অর্থ হল: তিনিই আল্লাহ তা’আলা, শূন্য থেকেই সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা, উদ্ভাবক, নজিরবিহীন রূপদাতা, উত্তম নামসমূহ তাঁরই। নভোমন্ডলে ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অস্তিত্বদানের শেষ বা তৃতীয় পর্যায়ের প্রক্রিয়াকে বলা যায় রূপদান। প্রথম দুই পর্যায় সম্পন্ন হয় মহান আল্লাহর খালিক ও বারিয়ু নামের আলোকে। আল্লাহর মুসাওয়িরু নামের আলোকেই রূপ পেয়ে থাকে নানা সৃষ্টি বা অস্তিত্ব।

সুরা ইনফিতারের সপ্তম ও অষ্টম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমার অঙ্গকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন। যিনি তোমাকে তাঁর ইচ্ছামত আকৃতিতে গঠন করেছেন।

মুসাওয়ির শব্দটি এসেছে সুরাত শব্দ থেকে। অভিধানে এমন কাউকে মুসাওয়ির বলা হয় যিনি তার সৃষ্ট বস্তু বা অস্তিত্বকে এমন আকৃতি দেন যে তা অন্যদের আকৃতির চেয়ে ভিন্ন। মহান আল্লাহই সবচেয়ে সুন্দর আকৃতি দিয়ে থাকেন সৃষ্টিকে।  সৃষ্টিকুল ও সৃষ্টি-জগত মহান আল্লাহর মুসাওয়ির নামের প্রকাশ। সুরা সিজদা'র সপ্তম আয়াতে বলা হয়েছে: যিনি তথা মহান আল্লাহ তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন।

আমরা যদি সৃষ্টি জগতের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব যে প্রত্যেক সৃষ্টির রয়েছে বিশেষ সৌন্দর্য এবং সেসবের গঠন, আয়তন, কর্মপদ্ধতি ও বাহ্যিক নানা দিক -সব মিলিয়ে যা যা আছে সেসবের চেয়ে পরিপূর্ণ ও উন্নত কিছু কল্পনা করা যায় না।

 সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানুষকে দেয়া হয়েছে সর্বোত্তম আকৃতি। তাই সুরা তাগ্বাবুনের তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে: তিনি নভোমন্ডল ও ভূমণ্ডলকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর সুন্দর করেছেন তোমাদের আকৃতি। তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তন।

মানুষের আকৃতিতে যেখানে কান, চোখ ও নাক ইত্যাদি রয়েছে সেসব যদি অন্য কোনো আকারে ও শরীরের অন্য কোনো স্থানে থাকতো তাহলে অবশ্যই মানুষের সৌন্দর্য ব্যহত হত। মানুষকে যে শারীরিক গঠন দেয়া হয়েছে সে কারণে মানুষ নানা ধরনের কাজ করতে পারে ও সূক্ষ্ম নানা শিল্প নির্মাণে সক্ষম। নানা ধরনের অঙ্গ থাকার কারণে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারে এবং জীবনের নানা উপকরণকে কাজে লাগাতে পারে।

অনেক প্রাণী বা পশু আছে যারা পানি ও খাবার হাত দিয়ে না খেয়ে সরাসরি মুখ দিয়ে খায়। কিন্তু মানুষ পানীয় ও খাবার গ্রহণের আগে হাত দিয়ে ভালোভাবে পরখ করে দেখতে পারে এবং স্বাস্থ্যসম্মত ও পবিত্র খাবার বেছে নিতে পারে। খাদ্যের অপ্রয়োজনীয় বা আবর্জনার অংশটুকু মানুষ সহজেই ফেলে দিতে পারে। মানুষ ফলের খোসা বা চামড়া আলাদা করতে পারে।

সুরা ত্বাগাবুনে মানুষকে আকৃতি দানের যে কথা এসেছে তার অর্থ মহান আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন ভারসাম্যপূর্ণ, উপযুক্ত বা যথাযথ ও  সুঠাম শরীর আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সুস্থ অনুভূতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য। মানব-দেহের অঙ্গগুলোর অবস্থানও পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত ও  মানবীয় প্রবৃত্তিগুলোর আলোকে সুসমন্বিত।

 মানুষ যখন কোনো কিছুর ছবি আঁকে বা কোনো কিছুতে আকৃতি দান করে তখন তার কাছে থাকে ওই বিষয় সম্পর্কিত পূর্ববর্তী দৃষ্টান্ত বা মডেল। কিন্তু মহান আল্লাহ অতীতের অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রত্যেক সৃষ্টিকে দিয়েছেন নানা আকৃতি ও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য।  

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) মহান আল্লাহর বিস্ময়কর নানা সৃষ্টি প্রসঙ্গে নাহজুল বালাগ্বার ১৬৫ নম্বর খোতবায় বলেছেন:  জীবিত, জীবনবিহীন, স্থির ও চলমান অনেক বিস্ময়কর প্রাণী ও বস্তু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাঁর সূক্ষ্ম সৃষ্টি ক্ষমতা ও কুদরতের এমন সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করেছেন যাতে মানুষের মন তার স্বীকৃতি স্বরূপ আল্লাহর প্রতি ঝুঁকে পড়ে ও আনুগত্য করে এবং তাঁর একত্বের সুর যেন আমাদের কানে বাজে। তিনি বিভিন্ন আকৃতির পাখী সৃষ্টি করেছেন। এদের কোনটি মাটি খুড়ে গর্ত করে বাস করে, কোনটি খোলা জায়গায় এবং কোনটি পর্বতের চূড়ায় বাস করে। এদের বিভিন্ন প্রকারের পাখা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আল্লাহর কর্তৃত্বের রশির মাধ্যমে এরা নিয়ন্ত্রিত। এরা পাখা ঝাপটিয়ে খোলা আকাশে দ্রুত উড়ে বেড়ায়। এক অদ্ভুত আকৃতিতে তিনি এদের অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন এবং অস্থি ও গ্রন্থি মাংশাবৃত করে তৈরি করেছেন। এদের কতেককে ভারী দেহের কারণে সহজে উড়ে বেড়ানো থেকে বিরত করেছেন এবং পাখা ব্যবহার করে মাটি থেকে অল্প উপরে চলার অনুমতি দিয়েছেন।

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) আরও বলেছেন, মহান আল্লাহ তাঁর ক্ষমতা ও সৌন্দর্যপূর্ণ সৃজনশীলতা দিয়ে পাখিদের বিভিন্ন রঙে সৃষ্টি করেছেন । এদের মধ্যে কোন একটির বর্ণের ওপর অন্য বর্ণের আভা থাকলে তা অন্য কোনটির সাথে মিলবে না। কোন কোনটির আবার এক রঙের আভা থাকে এবং তাদের গলায় বিভিন্ন রঙের রিং করা থাকে যা দেহের রঙ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

পাখীর মধ্যে ময়ূর হচ্ছে বিস্ময়কর সৃষ্টি যা আল্লাহ অতি প্রতিসম মাত্রায় সৃষ্টি করেছেন এবং এর রঙ সুন্দরভাবে পাখায় ও লম্বা লেজে সন্নিবেশ করেছেন। ময়ূর যখন ময়ুরীর কাছে যায় তখন ময়ূরী লেজ উত্তোলন করে এমনভাবে ছড়িয়ে দেয় মনে হয় যেন সে ময়ুরের মাথায় ছায়া দিচ্ছে। এ সময় লেজ দেখলে মনে হয় নৌকায় তোলা পাল । এরা নিজের রঙের জন্য গর্ববোধ করে এবং সদম্ভে চলাফেরা করে।

মাতৃগর্ভে মানুষের ভ্রুণের বিচিত্রময় ও পর্যায়ক্রমিক বিকাশও বিস্ময়কর। অন্ধকার মাতৃগর্ভে খুব ক্ষুদ্র দুটি কোষ বা বিন্দু মিলিত হয়ে ধীরে ধীরে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই রূপ নেয় মানুষের আকারে। যেন এক মহাদক্ষ শিল্পী দিনরাত বসে বসে সেখানে খুব সূক্ষ্ম অঙ্গের এই জটিল ও খুব সুসজ্জিত এবং ত্রুটিমুক্ত বিস্ময়কর মানব শিশু গড়ে তোলেন।  মানুষের মধ্যেও রয়েছে নানা চেহারা, আকৃতি, লিঙ্গ ও বিচিত্রময় স্বভাব ও বিচিত্র মেধা আর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি। মানুষের চোখ, নাক, ভ্রু, মুখ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র। মহান আল্লাহ বলেছেন:

তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেন মায়ের গর্ভে এক ফোটা পানির মধ্যে, যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশীল, প্রজ্ঞাময়।

মানুষ যে স্বর্গরাজ্যের ছবি আকে মনে মনে তাও মুসাওয়ির নামের সহায়তায় করে থাকে। মানুষ চরম সুখময় ও সৌভাগ্যময় এমন এক জগতের কল্পনা করে যেখানে নেই অন্ধকার ও পাপ-পংকিলতা, নেই অশালীন কথা ও কাজ, বরং রয়েছে আলোর বন্যা, সুদৃশ্য প্রাসাদ, সুরম্য উদ্যান আর প্রবহমান নদ। উদ্যানগুলোর পাশ দিয়ে বয়ে চলছে দুধ ও মধুর নহর। সেখানে রয়েছে কুরআনে বর্ণিত ফেরেশতাদের সান্নিধ্য। এইসব কল্পনা ও সুখের ছবি যারা আঁকেন তারা মহান আল্লাহর উপাসনা ও আল্লাহর সাক্ষাতের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যাকুল হয়ে আছেন। যখন পাপ-বর্জন করা তথা চোখ, কান, খাদ্য ও আত্মাকে দূষণমুক্ত রাখাও যত বেশি মাত্রায় সম্ভব হবে সুখময় এইসব কল্পনাও একদিন ততই বেশি বাস্তব ও যথাযথ হবে। ইবাদাত ও মহান আল্লাহর আনুগত্য মানুষের কল্পনাকে শক্তিশালী করে। আর এর বিপরীতে যারা ইবাদাত করে না ও আল্লাহর অনুগত নয় তাদের কল্পনা শক্তি বাস্তবতাকে তাদের কাছে উল্টোভাবে তুলে ধরে।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে যেন সবচেয়ে সুন্দর আচরণ আর কাজের রেকর্ড গড়ার সুযোগ দেন যাতে পরকালে আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্ত থাকা যায়।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।