আসমাউল হুসনা (পর্ব-১৭)
মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম ক্বাহ্হার। পবিত্র কুরআনে ছয় বার এ শব্দটি এসেছে।
এ নামের উৎস শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব। অন্য কথায় ক্বাহ্হার হলেন তিনি যিনি মানুষসহ সব সৃষ্টি ও সব কিছুর ওপর কর্তৃত্ব, পরাক্রম ও আধিপত্য রাখেন। মহান আল্লাহ বিশ্বের সব কিছুর ওপর এবং বিশ্বের সব বলদর্পীদের ওপরও তিনি নিরঙ্কুশ আধিপত্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও বিজয়ের অধিকারী। মহান আল্লাহর ইচ্ছার মোকাবেলায় সবাইই অক্ষম এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সবাই নতজানু। এক্ষেত্রে কেউই বিন্দুমাত্র বাধাও সৃষ্টি করতে পারে না।
ক্বাহ্হার মহান আল্লাহর জালালি তথা শক্তিমত্তা ও পরাক্রমের ঔজ্জ্বল্যে ভরপুর নামগুলোর অন্যতম। এ ধরনের আরেকটি নাম হল মুন্তাক্বিম বা প্রতিশোধ গ্রহণকারী কিংবা আযিয বা পরাক্রান্ত। অন্যদিকে মহান আল্লাহর জামালি বা দয়া, প্রেম ও করুণার মত প্রশান্ত-সৌন্দর্যজ্ঞাপক নামগুলো হল রাহমান, রাহিম ও গাফ্ফার বা সাত্তার ইত্যাদি। অবশ্য বাবার ক্রোধ বা রাগের মধ্যেও যেমন সন্তানের প্রতি ভালাবাসা ও স্নেহ লুকিয়ে আছে তেমনি মহান আল্লাহর জালালি নামগুলোর মধ্যেও দয়া ও করুণার সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। সুরা বাকারার ১৭৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
হে বুদ্ধিমানরা! প্রতিশোধ বা কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে রয়েছে জীবন, যাতে তোমরা খোদাভীরু হতে পার।-অর্থাৎ এই কিসাস বা প্রতিশোধ হচ্ছে এমন এক ক্ষণস্থায়ী ক্রোধ যা বইয়ে দেয় অব্যাহত জীবন, দয়া ও প্রশান্তির ধারা।

ক্বাহ্হার বলা হয় এমন এক মহাপরাক্রান্ত বিজয়ী কাউকে, যার মোকাবেলায় কেউ বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করে না, বরং পরিপূর্ণ নতজানু হয়। তাই যখন মানুষের ক্ষেত্রে কেউ এই কাহ্হার বা পরাক্রান্ত বা বিজয়ী শব্দটি ব্যবহার করে তখন সেক্ষেত্রে প্রতিরোধ মোকাবেলার পর ধীরে ধীরে বিজয়ী হওয়ার অর্থ ফুটে উঠে। কিন্তু মহান আল্লাহর কাহ্হারিয়াত এমনই যে তা যেন আগুনের ক্ষুদ্র বিন্দুর মধ্যে পানি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগুনকে নিভিয়ে দেয়ার মতই খুব দ্রুত বিজয়ী।
সুরা নুর-এ মহান আল্লাহকে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের জ্যোতি বলে তুলনা করা হয়েছে। তাই অনেক আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞানী আরেফ মহান আল্লাহর কাহ্হার হওয়ার বিষয়টিকে আল্লাহর নুরের কর্তৃত্ব বা আধিপত্য বলে তুলনা দেন বা ব্যাখ্যা করেন। এই আলোর তীব্রতা এতই বেশি যে তা বিজয়ী বা কাহ্হার। ঠিক যেমনি সূর্যের আলোর তীব্রতার কারণে দিনের বেলায় অন্য তারকারাজি দেখা যায় না। ঠিক এ জন্যই মহান আল্লাহ তাঁর কাহ্হার নামটিকে প্রয়োগ করেছেন কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসের ক্ষেত্রে।
কিয়ামত বা পুনরুত্থানের দিন জীবনের সব বাস্তবতা ফুটে উঠবে। গোপন বা অদৃশ্য ও প্রকাশ্য সব বাস্তবতা সেদিন সবার কাছেই স্পষ্ট হবে। সেদিন মহান আল্লাহ নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই জবাবে বলবেন: আজ মালিকানা ও বাদশাহি কার? একমাত্র কাহ্হার আল্লাহরই। -আসলে বর্তমান দুনিয়ার মালিকানা ও কর্তৃত্বও খোদারই হাতে রয়েছে। কিন্তু কিয়ামতের দিন সবার ওপরই এই মালিকানা ও কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ হয়ে দেখা দেবে। কাহ্হার বিজয়ী অর্থে ক'হের শব্দের সর্বাধিক্য বোঝায়। বান্দাহ বা সৃষ্টিকুলের সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির তোয়াক্কা না করেই মহান আল্লাহ যা খুশি তা করেন। মহান আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সব কিছুই নতজানু ও পরাস্ত এবং আত্মসমর্পিত।
মহান আল্লাহ সব কিছুর ওপর বিজয়ী হলেও কেউই তার ওপর বিজয়ী নয়। তাই মহান আল্লাহর বিজয় হচ্ছে অপরিসীম। মহান আল্লাহ হচ্ছেন এমন এক বাদশাহ যার চেয়ে নেই আর কোনো বড় বাদশাহ।
সুরা রা'দ-এর ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: বলুনঃ আল্লাহই প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা এবং তিনি একক পরাক্রমশালী।-অন্য কথায় পরাক্রান্ততার দিক থেকে মহান আল্লাহ অনন্য ও তার পরাক্রান্ততা অসীম। তাই মহান আল্লাহর অন্য অনেক অনন্য গুণের মত কাহ্হার গুণটিও অনন্য। মহান আল্লাহ মাত্র একজন হয়ে আছেন এ কারণেই, দুর্বলতা বা কোনো নেতিবাচক গুণের জন্য নয়। অন্য সবার ক্ষেত্রে স্বল্পতা বা একত্ব দুর্বলতার অর্থবোধক হলেও মহান আল্লাহর একত্বের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। হযরত ইউসুফ (আ) কারাগারে সঙ্গীদের কাছে মহান আল্লাহর একত্ববাদের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন নানা ধরনের খোদা উত্তম না সব কিছুর ওপর কর্তৃত্বশীল ও পরাক্রান্ত বা বিজয়ী এক আল্লাহ বা এক খোদাই উত্তম?
একেক মানুষ যদি একেক কল্পিত খোদার উপাসনা করে বা বহু কল্পিত খোদার উপাসনা করে তাহলে সেখানে দেখা দেয় মতভেদ ও বিচ্ছিন্নতা ও কপটতা। এ অবস্থায় তাদের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ পায় অত্যাচারী রাজারা। কিন্তু জনগণ যদি এক খোদার তথা সত্যিকারের খোদার একত্ববাদী পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয় ও কেবল এক খোদার ইবাদাত করে তাহলে তারা স্বৈরশাসকদেরকে সমাজ থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে বলে হযরত ইউসুফ যুক্তি দেখিয়েছিলেন। সে যুগের স্বৈরশাসকরা বানোয়াট অভিযোগ আরোপ করে মানুষকে কারাবন্দী করত। মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষ যাদের উপাসনা করত তারা ছিল তাদেরই সৃষ্ট কিছু ভিন্ন ভিন্ন নাম মাত্র যা গড়ে তুলেছিল তাদেরই বাপদাদারা।
মানুষ যদি আল্লাহর শত্রুদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে তারা যেন মহান আল্লাহর কাহ্হার গুণের কিছুটা কার্যকারিতা বা উপকারিতা অনুভব করল। তবে এ জাতীয় শত্রুর ওপর জয়ী হয়েও অহংকারী হওয়া যাবে না। ফেরাউনরা বনি ইসরাইলের মোকাবেলায় নিজেদেরকে কাহ্হার বা বিজয়ী মনে করত। তাদের ওপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ফলাতে চাইত ফেরাউনের দল। কিন্তু নিরঙ্কুশ কাহ্হার তো একমাত্র আল্লাহ। তাই ফেরাউনসহ যেসব গোষ্ঠী খোদাদ্রোহিতা ও জুলুমে লিপ্ত হয়েছিল তারা মহান আল্লাহর এক ইশারাতেই ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমান যুগের পরাশক্তিগুলো ও ইহুদিবাদী ইসরাইলের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার যে তাদের কর্তৃত্বও শেষ হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ কেবল কাফের ও জালেমদের ওপরই বিজয়ী নন। মহান আল্লাহ সব ক্ষেত্রেই প্রবল পরাক্রান্ত তথা কাহ্হার বা বিজয়ী বলেই সৃষ্টি জগতে টিকে আছে নিয়মের রাজত্ব। আল্লাহ যদি সৌর জগতকে এ নিয়মের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম করতেন তাহলে এই জগত ধ্বংস হয়ে যেত। প্রকৃতির জগতে যদি কোনো অনিয়ম দেখা দেয় তাহলে মহান আল্লাহ ছাড়া কেউই তাকে সুশৃঙ্খল করতে পারবে না। আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোও মেনে চলছে মহান আল্লাহর কাহ্হারিয়াত এবং এ জন্যই দেহ ও আত্মাসহ আমাদের সব কিছুর মধ্যে রয়েছে সমন্বয়।
اللَّهُمَّ عَظُمَ سُلْطَانُكَ وَ عَلاَ مَكَانُكَ وَ خَفِيَ مَكْرُكَ
হে আল্লাহ ! বিশাল তোমার সাম্রাজ্য এবং মহিমান্বিত তোমার মর্যাদা এবং তোমার পরিকল্পনা দৃশ্যাতীত
وَ ظَهَرَ أَمْرُكَ وَ غَلَبَ قَهْرُكَ وَ جَرَتْ قُدْرَتُكَ
অস্তিত্বজগতে তোমার ক্ষমতা স্পষ্ট , তোমার শক্তি সবকিছুর উপর বিজয়ী , তোমার কর্তৃত্ব সর্বব্যাপী
وَ لاَ يُمْكِنُ الْفِرَارُ مِنْ حُكُومَتِكَ
এবং অসম্ভব তোমার সাম্রাজ্য থেকে পলায়ন#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।