আসমাউল হুসনা (পর্ব-১৯)
মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম রায্যাক। এর অর্থ রুটি-রুজি ও আয়-উপার্জন বা রিজিক- জাতীয় জিনিষের দাতা ও স্রষ্টা।
পবিত্র কুরআনে সরাসরি একবার এ শব্দটি এসেছে, তবে কুরআনের অনেক বাক্যে রাযযাক-এর সমার্থক অনেক শব্দ দেখা যায়। যে কোনো ইতিবাচক বা কল্যাণকর বিষয় যা মানুষ ও সৃষ্টিকুলের জীবন অব্যাহত রাখার কারণ হয় তা-ই রিজিক। রায্যাক নামটি মহান আল্লাহর দয়া ও করুণার অন্যতম প্রকাশ।
রিজিক দুই ধরনের হতে পারে। পার্থিব ও বস্তুগত এবং পারলৌকিক ও আধ্যাত্মিক। তাই খাদ্য, পোশাক ও বাসস্থান ছাড়াও জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি, ঈমান, উপলব্ধির ক্ষমতা, দূরদর্শিতা, শিল্পবোধ একনিষ্ঠতা -এসবও রিজিক হিসেবে বিবেচিত।
মহান আল্লাহ সুরা আলে ইমরানের ১৬৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
'আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার কাছে জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।'
- এখানে ইহ ও পরকালীন জগতের মাঝামাঝি জগত তথা আলমে বারযাখে থাকা শহীদদের যে রিজিক দেয়ার কথা বলা হয়েছে তা আধ্যাত্মিক রিজিক।
সুরা হজের ৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, যারা আল্লাহর পথে গৃহত্যাগ তথা হিজরত করেছে, এরপর নিহত হয়েছে অথবা মরে গেছে; আল্লাহ তাদেরকে অবশ্যই উৎকৃষ্ট জীবিকা দান করবেন এবং আল্লাহ সর্বোৎকৃষ্ট রিজিক দাতা।
শ্রেষ্ঠ আসমানি মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনে নবুওতকেও রিজিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন থেকে উপকৃত হওয়াকেও আসমানি এ মহাগ্রন্থের সুরা ওয়াক্বেয়ার ৮২ নম্বর আয়াতে রিজিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুরা কাসাস-এর ৫৭ নম্বর আয়াতের একাংশে মহান আল্লাহ বলছেন,
আমি কি তাদের জন্যে একটি নিরাপদ হারাম প্রতিষ্ঠিত করিনি? এখানে সর্বপ্রকার ফল-মূল আমদানি হয় (বিশ্বের সব অঞ্চলের দেশ ও শহর থেকে) আমার দেয়া রিজিকস্বরূপ। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।– সুরা ত্বালাকের প্রথম দিকে বলা হয়েছে:

যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।-এখান রিজিক বলতে জালিমদের মোকাবেলায় মু'মিনদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অলৌকিক সহায়তাও হতে পারে- যা কেউ চিন্তাও করেনি বা করে না।
সুরা হুদের ষষ্ঠ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, আর পৃথিবীতে বিচরণশীল এমন কোন জীব বা প্রাণী নেই, যাদের সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ'র হাতে ন্যস্ত নয়। -
মহান আল্লাহ সবারই রিযিকদাতা। কিন্তু তিনি সরাসরি সবাইকে রিজিক দেন না। মানুষের কর্ম-প্রচেষ্টার ওপরও নির্ভর করে তাদের রিজিক। সুরা নাযম্-এর ৩৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: মানুষ তাই পায়, যা সে করে।–
মহান আল্লাহর নবী-রাসুলরাও কঠিন পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করতেন। মহান আল্লাহকে ও ধর্মকে সবচেয়ে বেশি বুঝেছেন নবী-রাসুল ও পবিত্র ইমামরা। মহান আল্লাহকে রিযিকদাতা জেনেও তাঁরা আয়-উপার্জনের জন্য কর্ম-প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকেননি! বরং তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করে আয়-উপার্জন করতেন যাতে অন্যরাও এ থেকে শিক্ষা নিয় শ্রমের মর্যাদা উপলব্ধি করেন।
অনেক সময় এমনও হয় একজনের কাজের ফল তারই অসচেতনতার কারণে অন্য কেউ নিয়ে যায় বা ওই ফল নষ্ট হয়। পৃথিবীতে খাদ্য, পোশাক ও নানা ধরনের উপকারী দ্রব্যের পরিমাণ মানুষের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি বা কয়েক গুণ পরিমাণে মজুদ রয়েছে। কিন্তু মানুষকে তা সংগ্রহ করে নিতে হবে ও নিজ অধিকার আদায় করতে হবে। অথচ দুঃখজনকভাবে বিশ্বের ৮২ শতাংশ সম্পদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বা তারা এই সম্পদ দখল করে রেখেছেন। অথচ মহান আল্লাহ এইসব রিজিক দিয়েছেন সবার জন্য। বিশ্বের বঞ্চিত জাতিগুলো ও মানুষেরা কি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ও সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে লুটেরাদের কাছ থেকে তাদের হৃত অধিকার ফিরিয়ে আনতে সক্ষম নন?
লুটেরা ও শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা নবী-রাসুলদের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই নবী-রাসুলদের প্রচারিত এই শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে তারা দারিদ্র, ক্ষুধা ও শ্রেণী-বৈষম্যের শিকার।
পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে রিজিকের প্রবৃদ্ধি ও হ্রাস মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সুরা আসরা'র ত্রিশ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা যাকে ইচ্ছা বেশি জীবনোপকরণ দান করেন এবং তিনিই তা সংকুচিতও করে দেন।
- তাই রিজিক বৃদ্ধি ও হ্রাস মহান আল্লাহর কৌশল বা প্রজ্ঞারই বিষয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও হালাল উপার্জনের জন্য চেষ্টা ও প্রচেষ্টা রিজিক বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে। অবশ্য এই প্রভাব খুবই সীমিত। যেমন, মানুষকে চাল উৎপাদনের জন্য ধান চাষ করতে হয় এবং এ জন্য বীজ রোপণ ও সেচসহ অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু একটি ধান থেকে যে একশত ধান আসে তা মহান আল্লাহরই অনুগ্রহ মাত্র।
সুরা ওয়াক্বেয়ার ৬৩ ও ৬৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, তোমরা যে বীজ বপন কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তার অঙ্কুরোদগম ঘটাও বা উৎপন্ন কর, না আমি তা করি? আমি ইচ্ছা করলে তাকে খড়কুটা করে দিতে পারি, অতঃপর হয়ে যাবে তোমরা বিস্ময়াবিষ্ট।–
-পবিত্র কুরআন হালাল ও পবিত্র রিজিককেই কেবল রিজিক বলে উল্লেখ করে। এ কারণে কুরআনে রিজিক শব্দটি ১৩ বার তাইয়্যেব বা পবিত্র শব্দের পর এসেছে। রিজিক শব্দের পাশে হালাল শব্দটির ব্যবহারও লক্ষণীয়। সুরা মায়েদার ৮৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ তা’য়ালা যেসব বস্তু তোমাদেরকে দিয়েছেন, সেসব থেকে হালাল ও পবিত্র বস্তু খাও এবং আল্লাহকে ভয় কর, যার প্রতি তোমরা বিশ্বাসী।
- এ আয়াত থেকে বোঝা যায় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত সব রিজিকই হালাল বা বৈধ। তবে বৈধ কিছুও যদি অবৈধভাবে অর্জন করা হয় তা হালাল থাকে না বরং হারাম হয়ে যায়।- প্রকৃত রিযিকদাতা হলেন একমাত্র আল্লাহ। অন্যরা মহান আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমতার কারণে বা আল্লাহর অনুমতিক্রমে অস্থায়ীভাবে রিজিক পৌঁছে দেয়ার কাজ করতে পারে। তবে আমরা যদি মহান আল্লাহর রাজ্জাক নামের রঙে রঙিন হতে চাই তাহলে আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও রিজিকগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি আল্লাহর বান্দাদেরও মহান আল্লাহর দেয়া সম্পদ থেকে কিছু অংশ দান করা উচিত।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।