জুলাই ১৫, ২০২১ ১২:০৪ Asia/Dhaka

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে আমি গাজী আবদুর রশীদ। স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে গেলেই দৈহিক এবং মানসিক দুটি স্বাস্থ্যের বিষয় সামনে আসে। দু’রকমের স্বাস্থ্যের বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মানসিক স্বাস্থ্যকে সাধারণত মানুষ কম গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য দৈহিক স্বাস্থ্যের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং বেশিই বলা চলে।

আমরা আজকের স্বাস্থ্যকথার আসরে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করব। আর এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য আমাদের সাথে রয়েছেন বিশিষ্ট সাইকোসোস্যাল কাউন্সিলর-নাসিমা বেগ ঝুনু। তিনি বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরের স্বদেশ হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড এ কর্মরত আছেন। তো নাসিমা বেগম ঝুনু রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্য কথার আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: নাসিমা বেগম ঝুনু,মানসিক স্বাস্থ্য কাকে বলে সে বিষয়টি আপনি এর আগের পর্বে চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আজ আপনার কাছে প্রথমে জানতে চাইব-মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব কি বা কতখানি?

নাসিমা বেগম ঝুনু: দেখুন,রেডিও তেহরানের দর্শক ও শ্রোতাদেরকে জানাচ্ছি সালাম ও শুভেচ্ছা। আশাকরি সবাই ভালো আছেন। ধন্যবাদ জানাচ্ছি আবদুর রশীদ ভাইকে। গতপর্বে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমি বলেছিলাম, মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে- মানুষের মন, আচরণগত এবং আবেগপূর্ণ স্বাস্থ্য। শারীরিক সুস্থতার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুস্থ জীবনের জন্য এবং শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে তাহলে সে কি কি করতে পারে?

এক. দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে।

দুই. বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে।

তিন. পরিবার ও সমাজের সাথে অ্যাডজাস্ট করে চলতে পারে।

চার. বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

পাঁচ. সেই ব্যক্তি প্রডাক্টিভ হয়ে ওঠেন এবং নিজের ও সমাজের উন্নয়নে খুব ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন।

তাহলে দেখুন,মানসিক স্বাস্থ্য কত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্য যার ভালো থাকবে সে মানবসম্পদে পরিণত হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে গোটা বিশ্ব

করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মক বিপর্যয়ের সন্মুখীন। বিশেষজ্ঞদের মতে করোনার বাইরে যে ঝুঁকিটা এসেছে সেটি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য। তাই আসুন আমরা মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেই।

গুরুত্বের দুটো দিক আমি তুলে ধরতে চাই। মানসিক স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে তাহলে সেই ব্যক্তি মনোযোগ দিতে পারে তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রতিটি কাজে। সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সমাজ, দেশ এবং পরিবারের জন্য উৎপাদনশীল কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। নিজেকে সবসময় অ্যাক্টিভ রাখতে পারে। এসব বিষয় মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের প্রথম দিক।

মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে, আমাদের সমাজে একটি সামাজিক প্রথা কিংবা রীতি-নীতি আছে যে মানসিকভাবে যখন কেউ অসুস্থ হয় আমরা তাকে পরিবেশগত বিভিন্ন ধরণের শাসন কিংবা কমান্ড দিয়ে তাকে ডোমিনেন্ট করে রাখি। হঠাৎ একসময় সেটা অ্যাঙ্গার আউটব্রাসডের মাধ্যমে আউটব্রাসড হয়। এমন চাপের মাধ্যমে আমরা তাকে সামাজিকভাবে রেখে দেই যে সেটি একসময় হরমোন সিক্রিয়েশন হয় এবং তা  ব্রেনে নিউরো ট্রান্সমিটারে সিক্রিয়েশন হয় এবং সেখান থেকে সে অ্যানজাইটি ডিসঅর্ডারে ভুগতে শুরু করে। তখন তার দেখা দেয় ডিপ্রেশন, ফোবিয়া, প্যানিক ডিসঅর্ডার অথবা অফসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি যেটাকে শূচিবায়ু রোগ বলে-এসব রোগে ভোগে।

দেখুন, আমার চেম্বারে অনেক রোগী এসেছেন। একজন রোগী ছিলেন যিনি ২০ বছর ধরে পারিবারিক জীবনে স্ট্রেসের মুখোমুখি। সেখান থেকে তার অ্যানজাইটি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে তিনি এখন বিভিন্ন ধরণের অসুখ এবং মারাত্মক আকারের শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তিনি মেডিসিনের ডাক্তার দেখিয়েছেন। তার সব রিপোর্ট ভালো অথচ তার চেস্ট পেইন এবং শ্বাসকষ্ট। এটি শুধুমাত্র তাকে অযত্নের কারণে হয়েছে। তবে এজন্য তাকে কোনো মনোরোগ চিকিৎসক কিংবা কাউন্সিলিংয়ের জন্য নেয়া হয় নি। বিশ বছর পর এখন তিনি ফিজিক্যাল ডিসঅর্ডারে ভুগছেন।

আমাদের সমাজে আসলে মানসিক রোগটাকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দেয়া হয় না। অথচ এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা একটি কথা শোনা যায় বাংলাদেশ সহ বিশ্বে মানসিক রোগীর সংখ্যা প্রায় মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ এবং তা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু মানুষ দৈহিক অসুস্থতাকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকনে মানসিক রোগের সেভাবে গুরুত্ব দেন না। আপনি এ সম্পর্কে কি বলবেন। কেন গুরুত্ব দেন না। গুরুত্ব না দেয়ার পরিণতি কি হতে পারে?

নাসিমা বেগম ঝুনু: মানসিক স্বাস্থ্যকে আমরা কেন গুরুত্ব দেই না তার অর্ন্তনিহিত কিছু কারণ আছে।

প্রথম কারণ হচ্ছে, মন কিংবা মনের সমস্যা বা মানসিক ব্যধী সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা। শারীরিক অন্যান্য অসুখের মতোই মনের যে অসুখ হতে পারে সে সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই স্পষ্ট ধারণা রাখেন না।

দ্বিতীয়ত-অনেকে মনে করেন মানসিক রোগ মানেই পাগল। আর সাইক্রিয়াটিস্ট মানেই হচ্ছে পাগলের ডাক্তার। কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ সেরকম নয়। মানসিক রোগ মানে পাগল নয় আর মানসিক রোগের ডাক্তার মানে পাগলের ডাক্তার নয়। মনের অসুস্থতাকে সামান্য কিছু কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সুস্থ করার বিষয়টি অনেক জরুরি।

তৃতীয় কারণ হচ্ছে,সামাজিক একটা ব্যধির মতো। মানসিক সমস্যা নিয়ে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাব চিকিৎসার জন্য! লোকে জানলে কি বলবে? আর এ কারণে দেখা যায় অনেক রোগীই লুকিয়ে থাকে।

চতুর্থ কারণ হচ্ছে- মানসিক ব্যধি সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত বিশ্বাস। যেমন অনেকেই মনে করেন মানসিক ব্যধিকর মূলে জ্বিন ভুতের আছর। ব্লাক ম্যাজিক মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন জাদু টোনা। ফলে এখনও মানসিক চিকিৎসায় সবাই খোঁজেন  ঝাড় ফুক, তাবিজ কবজ ইত্যাদি। ফলে আজকের আমাদের সমাজে অনেকেই মানসিক রোগের চিকিৎসা করান না কিংবা গুরুত্ব দেন না।

রেডিও তেহরান: নাসিমা বেগম ঝুনু, মানসিক রোগ কি কারণে হয়ে থাকে। মানসিক রোগরে ধরণ বা লক্ষণগুলো কি? একইসাথে রোগগুলোর মোটামুটিভাবে নামগুলো যদি বলেন..

নাসিমা বেগম ঝুনু: মানসিক রোগ কি কারণে হয়ে থাকে সে সম্পর্কে গবেষকরা বলেন,কয়েকটি বিষয় মানসিক রোগের সাথে সরাসরি জড়িত।

এক.বংশগত। বাহনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

দুই.মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তন।

তিন.পরিবেশ এবং সামাজিক প্রভাব।

এতিনটি ছাড়াও শারীরিক নানাবিধ সমস্যার কারণে মানসিক রোগ হতে পারে। শারীরিক সমস্যা থেকে টেনশন করতে করতে একসময় এনজাইটি ডিসঅর্ডার হয়ে থাকে।

মানসিক রোগের লক্ষণ সম্পর্কে বলব- মানসিক অসুস্থতার শারীরিক লক্ষণ হচ্ছে হয় ওজন হারাবে অথবা ওজন অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষ করে যারা হতাশায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে।

দ্বিতীয়ত-বমি বমি ভাব হতে পারে।

তৃতীয়-মাইগ্রেনের ব্যথা।

চতুর্থ-সাইনাস

এছাড়া ব্যাকপেইন। দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা থাকবে। তাছাড়া চামড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।

মানসিক রোগ দুই ধরণের। একটাকে বলে সাইকোসিস। আরেকটি বলা হয় নিউরোসিস। নিউরোসিস এই টার্মটি প্রথম চালু করেন স্কটিশ একজন ডাক্তার। তিনি সাধারণভাবে নিউরোসিসকে বলেছেন- দুশ্চিন্তাগ্রস্তব্যধি। জেনারালইসড অ্যানজাইটি ডিসঅর্ডার, ফবিক অ্যানজাইটি,প্যানিক ডিসঅর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক ডিসঅর্ডার, অ্যাডজাসমেন্ট ডিসঅর্ডার, কনভারশন ডিসঅর্ডার।

আর নিউরোসিস রোগের উপসর্গ হচ্ছে দুশ্চিন্তা,হতাশা,মনোযোগের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা, অযৌক্তিক ভয়, চিন্তা, অতিরিক্ত রাগ, ঘুমের সমস্যা, অকারণে চিন্তা এবং নেতিবাচক চিন্তা।

অন্যদিকে সাইকোসিস হচ্ছে- ডিলেশন এবং হ্যালোসিনেশন। অর্থাৎ এই ধরণের মানসিক সমস্যাগ্রস্ত রোগী নিজের কোনো রোগ আছে এটি অস্বীকার করেন বা অনুভব করতে পারেন না। তাছাড়া চিন্তায় এবং আচরণে চোখে পড়ার মতো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়। তাদের মনে এ ধরনের চিন্তা আসে যে কেউ তাকে মেরে ফেলবে অথবা তার ক্ষতি করবে। তারা যেকোনো ধরণের অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে চরম অস্বাভিকতা দেখায়। কোনো পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলেত পারে না।

তো নাসিমা বেগম ঝুনু আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ।

আর শ্রোতাবন্ধুরা! এতক্ষণ মানসিক রোগের কারণ, ধরণ এবং লক্ষণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করলেন ময়মনসিংহ শহরের স্বদেশ হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে কর্মরত সাইকোসোস্যাল কাউন্সিলর নাসিমা বেগম ঝুনু। আপনারা সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন-নিজেকে নিরাপদ রাখুন।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৫

ট্যাগ