আসমাউল হুসনা (পর্ব-৪২)
মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল কারিম। এর অর্থ মহত্ত্ব, ক্ষমাশীলতা ও সততা ইত্যাদি।
সমস্ত পছন্দনীয় গুণ, কল্যাণ ও বিষয়ের সমাহার রয়েছে এই নামের মধ্যে। গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি একবার এক ব্যক্তি মহানবীর (সা) সামনে দোয়ার হাত উঠিয়ে বলছিলেন: ইয়া জালজালাল ওয়াল ইকরাম: হে জালাল ও দয়া বা অনুগ্রহের অধিকারী! -মহানবী (সা) বললেন, মহান আল্লাহকে যখন এই নামে ডেকেছ তোমার দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন, আল্লাহর কাছে যা ইচ্ছা তা চাও। - এখানে এই ইকরাম শব্দটি ও কারিম একই পরিবারভুক্ত শব্দ ।
সুরা আররাহমানের ২৬ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে: কুল্লুমান আলাইহা ফান ওয়াইবক্বা ওয়াযহু রাব্বিকা জুলজালালি ওয়াল ইকরাম।- এর অর্থ 'পার্থিব বা ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমায় ও মহানুভব পালনকর্তার যাত্ বা সত্তাই টিকে থাকবে'। - এখানে জালাল অর্থ মহিমা ও ইকরাম অর্থ মহানুভবতা। অনেকেই এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন মহান আল্লাহর দয়া ও করুণা এবং মহানুভবতা এসবই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, অনন্য গৌরব ও অসীম জালাল বা ঔজ্জ্বল্যের কারণেই বান্দাহরা পেয়ে থাকে।
মহান আল্লাহ দয়াশীল, করুণাময় ও ক্ষমাশীল। মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় করুণা হল মানুষকে তিনি অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন। যে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করতে পারেন তিনি মানুষকে মহীয়ান ও সম্মানিতও করতে পারেন। মহান আল্লাহর জালিল নামেরই পরিপূরক হল কারিম। সমস্ত পছন্দনীয় গুণ ও কল্যাণের উৎস এই নাম পবিত্র কুরআনে ২৬ বার এসেছে এবং তা নানা অর্থ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে দুই বার এই নাম মহান আল্লাহর পবিত্র নাম হিসেবে এসেছে কুরআনে।
কারামা থেকে উদ্ভূত কারিম শব্দটির আভিধানিক অর্থ উদার দানশীল বা মুক্ত হস্তে দানকারী এবং তিনি এমনই দানশীল যে অন্যদের অকৃতজ্ঞতা ও বিদ্রোহও তাঁর দানশীলতায় ব্যাঘাত ঘটায় না। কারিম হচ্ছেন এমন কেউ যিনি এমনকি না চাইলেও দান করেন এবং দান করে তিনি কোনো দানের কথা প্রকাশও করেন না ও দানের খোঁচা দেয়া তো দূরের কথা। এ ছাড়াও কারিম হচ্ছেন এমন কেউ যিনি খুব সহজেই অন্যদের ক্ষমা করে দেন এবং এমনকি অন্যদের অপকারের বা মন্দ কাজের জবাবে তিনি তাদের কল্যাণে নিয়োজিত হন!
একদিন মহানবীর (সা) এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেন যে ক্বিয়ামত বা বিচার দিবসে মানুষকে কার কাছে জবাবদিহি করতে হবে? মহানবী (সা) বললেন: আল্লাহর কাছে। ওই ব্যক্তি বললেন: যাক্ আমার ভয় বা দুশ্চিন্তা দূর হল! মহানবী (সা) তখন বললেন, এই ব্যক্তি ব্যাপারটির বাস্তবতা বুঝতে পেরেছে। সাহাবিরা ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে প্রশ্ন করে তাঁর ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারিম যিনি তিনি প্রতিশোধ নেয়ার বা শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে দেন।
ইলাহিয়াত নামের এক মুনাজাতে আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন, তোমার কারাম বা ক্ষমাশীলতার বিষয়টি যদি না জানতাম তাহলে তোমার পুরস্কারের আশা করতাম না, তুমি প্রত্যাশাকারীদের প্রত্যাশা পূরণকারী ও কারিমদের মধ্যেও তুমি সবচেয়ে বেশি কারিম ও পাপীদের ক্ষমা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দয়ালু, আর তুমি এমন কেউ যার কাছে রহমত চাওয়া হয় ।
কারিম বলতে পবিত্রতা ও সততার অধিকারীকেও বোঝায় । সুরা আল মুমিনুনের ১১৬ নম্বর আয়াতে সম্মানিত অর্থে মহান আল্লাহকে কারিম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে: মহান আল্লাহ বলছেন, অতএব শীর্ষ মহিমায় আল্লাহ, তিনি সত্যিকার মালিক, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি সম্মানিত আরশের মালিক।
কল্যাণকামী, লাভজনক, সৎ ও পবিত্র অর্থেও কারিম শব্দের ব্যবহার দেখা যায় পবিত্র কুরআনে। পবিত্র কুরআনকেও কুরআনুল কারিম বলা হয়েছে। এর কারণ এই মহাগ্রন্থ পবিত্র, সম্মানিত ও মূল্যবান, লাভজনক বা কল্যাণকর। দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্য এনে দেয় কুরআন। পবিত্র কুরআনের বাণী আল্লাহরই বক্তব্য। তাই মহান আল্লাহও কারিম, কুরআন নিজেও কারিম ও যিনি এই মহাগ্রন্থ উপহার এনেছেন সেই মহান নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)ও কারিম তথা রাসুলে কারিম ও নবী-কারিম। -
সুরা সাবার চতুর্থ আয়াতে মহান আল্লাহ রিজিক-এর সঙ্গে কারিম শব্দ ব্যবহার করে বলেছেন: তিনি পরিণামে যারা মুমিন ও সৎকর্ম পরায়ণ, তাদেরকে প্রতিদান দেবেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও পবিত্র, মূল্যবান ও সম্মান জনক রিজিক। -অনেক ব্যাখ্যাকারী সম্মানজনক ও মহামূল্যবান রিজিক অর্থে বেহেশতকেও কারিম বলে মনে করেন। কারণ, বেহেশতে মহান আল্লাহর সমগ্র কল্যাণের প্রকাশ ঘটেছে। সুরা আনফালের ৭৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
আর যারা ঈমান এনেছে, নিজেদের ঘর-বাড়ী ছেড়েছে এবং আল্লাহর রাহে জেহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য-সহায়তা করেছে, তাঁরা হলো সত্যিকার মুসলমান। তাঁদের জন্যে রয়েছে, ক্ষমা ও সম্মানজনক রুযী।
কারিম নাম আল্লাহর অন্য অনেক মহান নামের মত মহান আল্লাহর পূর্ণতার ও বিশেষ করে খোদায়ি দানশীলতার অন্যতম প্রকাশ। মানুষ তাই এই মহান ও সুন্দর নামের মুখাপেক্ষী। এ জন্যই অনেক মুসলমান মানুষ নাম রাখেন আবদুল কারিম। তথা কারিমের দাস। কারিম নামের রঙ্গে রঙিন ব্যক্তি ব্যাপক দানশীল হয়ে থাকেন। নিজে অভাবগ্রস্ত হলেও কারিম মানুষেরা অন্যের অভাব পূরণকেই নিজের অভাব পূরণের চেয়ে প্রাধান্য দেন।
আমিরুল মুমিনিন হযরত আলীর (আ) মতে মানুষের ক্ষেত্রেও কারিম হচ্ছেন তিনি যিনি ভালো কাজ করেন ও মানুষের উপকার করেন এবং তাদের সেবা করাকে নিজ দায়িত্ব বলে মনে করেন। ইমাম হাসানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কারামাত অর্থ কি? তিনি বলেছিলেন: কারামাত হচ্ছে মানুষের নানা সমস্যা যথাসম্ভব সমাধান করা এবং মানুষ তোমার কাছে আবেদন জানানোর আগেই তা করতে হবে। এ ছাড়াও ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী কারিম ব্যক্তি অন্যদের ভুল উপেক্ষা করেন এবং অন্যদের দোষ-ত্রুটি বুঝতে পেরেও তা না বোঝার ভান করেন। ফলে অন্যরা তাকে এসব ব্যাপারে উদাসীন বলেই মনে করেন।
কারিম ব্যক্তি মহান আল্লাহর রঙ্গে রঙিন বলে খুবই কৃতজ্ঞ প্রকৃতির হয়ে থাকেন। দৃশ্যত খুব সামান্য কিছু দান করা হলেও তিনি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ থাকেন। হযরত আলী বলেছেন, কারামাতের অধিকারী ব্যক্তি অল্প কিছু পেয়েও কৃতজ্ঞ থাকেন আর হীন প্রকৃতির মানুষ ব্যাপক নেয়ামত পেয়েও অকৃতজ্ঞ থাকে। তাই সদা-কৃতজ্ঞ থাকা কারিম প্রকৃতির মানুষের অন্যতম লক্ষণ। আমরা আজ এতক্ষণ যেসব গুণের কথা শুনলাম সেসব কারিম প্রকৃতির মানুষের কয়েকটি লক্ষণ মাত্র। কারণ কারিম ব্যক্তি হচ্ছে সব ধরনের মহৎ গুণের অধিকারী। যে কোনো ধরনের ক্ষুদ্রতা, নীচতা ও হীনতা থেকে মুক্ত থাকেন এ ধরনের ব্যক্তি।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।