ইকবালের গভীর ইরান-প্রেম ও ত্রাণকর্তা সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী
https://parstoday.ir/bn/radio/uncategorised-i17896-ইকবালের_গভীর_ইরান_প্রেম_ও_ত্রাণকর্তা_সম্পর্কিত_ভবিষ্যদ্বাণী
মরহুম আল্লামা ডক্টর ইকবাল ছিলেন একজন খুব বড় মাপের কবি, দার্শনিক ও ইসলামী সংস্কারক। ইসলামী জাগরণের কবি ও পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা বা আধ্যাত্মিক জনক হিসেবেও তার রয়েছে বিশেষ খ্যাতি।
(last modified 2025-10-12T12:48:31+00:00 )
আগস্ট ২২, ২০১৬ ১৮:৫৫ Asia/Dhaka
  • ইকবালের গভীর ইরান-প্রেম ও  ত্রাণকর্তা সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী

মরহুম আল্লামা ডক্টর ইকবাল ছিলেন একজন খুব বড় মাপের কবি, দার্শনিক ও ইসলামী সংস্কারক। ইসলামী জাগরণের কবি ও পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা বা আধ্যাত্মিক জনক হিসেবেও তার রয়েছে বিশেষ খ্যাতি।

ইকবাল কখনও সফর করেননি ইরান। কিন্তু ইরানের সংস্কৃতির প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ যে সংস্কৃতি ইসলামে রেখেছে অমূল্য ও মৌলিক অবদান।  ইরানের প্রতি আল্লামা ইকবালের গভীর অনুরাগ এবং বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে ইরানের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত ভূমিকার প্রতি তার অসাধারণ শ্রদ্ধাবোধ অনেকের কাছেই একটি অজানা বিষয়। ইরানের নেতৃত্বে ইসলামী সভ্যতার পুনরুত্থান ছিল তার এক বড় প্রত্যাশা, ভবিষ্যদ্বাণী ও স্বপ্ন। তাই আমরা এ বিষয়টিসহ প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য ও বক্তব্য তুলে ধরবো  'ইকবালের গভীর ইরান-প্রেম ও ত্রাণকর্তা সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী’ শীর্ষক এই বিশেষ আলোচনায়।  

মহাকবি ইকবাল ‘জামিয়াতই আকওয়াম’ বা ‘জাতিগুলোর সমিতি (জাতিসংঘ)’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন:
যদি তেহরান হয় জেনেভা প্রাচ্যের
তবে হয়তো বদলে যাবে তাকদির এ ধরণীর।’
জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ইকবাল যে থিসিস বা গবেষণাপত্র জমা দিয়েছিলেন তার বিষয়বস্তু ছিল ‘পারস্যে অধিবিদ্যা বা অবস্তুগত বিষয় সংক্রান্ত দর্শনের অগ্রগতি’। এই থিসিস ছিল পারস্যের কয়েক হাজার বছরের দর্শন-চিন্তা সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ সমীক্ষা যার মধ্যে রয়েছে সেই জরাথ্রুস্ত যুগ থেকে ইসলামী যুগ এবং ইসলামী যুগ থেকে উনবিংশ শতকের সমগ্র দর্শন-চিন্তার পর্যালোচনা।
 আল্লামা ইকবাল ইরানিদের উন্নত আচরণ, দার্শনিক মন, প্রাচীন সভ্যতা ও তাদের উন্নত সংস্কৃতির প্রশংসা করছেন। ‘মাকালাত ই ইকবাল’ নামে আল্লামা  ইকবালের নানা প্রবন্ধের একটি সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এতে ইকবাল এই মত তুলে ধরেন যে ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হল মুসলমানদের পারস্য বিজয়। কারণ, এ বিজয়ের ফলে পারস্য তথা ইরান এ অঞ্চলের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নসহ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
আল্লামা ইকবাল ১৯১০ সালে ভারতের আলীগড়ে ‘মুসলিম সম্প্রদায়:একটি সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা’ শীর্ষক এক আলোচনায় বলেন, ‘আমাদের মুসলিম সভ্যতা হচ্ছে সেমিটিক (আরব) ও আর্য (ইরানি) ভাবধারার মিশ্র-উর্বরায়নের ফসল। মুসলিম সভ্যতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে আর্য মাতার কোমলতা বা দয়া ও সূক্ষ্মতা বা পরিশীলতা এবং সেমিটিক বাবার উন্নত ও মহৎ চরিত্র। পারস্য জয়ের সুবাদে মুসলমানরা পেয়েছে তা-ই যা পেয়েছিল রোমানরা গ্রিস  জয়ের মাধ্যমে। কিন্তু পার্থক্য হল পারস্য না থাকলে আমাদের মুসলমানদের সংস্কৃতি হয়ে পড়ত চরম একপেশে।’
পারস্যের দর্শন সম্পর্কে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের লক্ষে ইকবাল যে গবেষণা করেছেন তা তার চিন্তাধারার ওপর বড় ধরনের প্রভাব রেখেছে। 
 মুহাম্মাদ ইকবাল লাহোরি ১৮৯০’র দশকে কবিতা লেখা শুরু করেন। প্রথমে তিনি কবিতা লিখতেন উর্দু ভাষায়। কিন্তু পিএইচডি অর্জনের জন্য ইউরোপে থাকার সময় তিনি ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার সিদ্ধান্ত নেন। আসরার ই খুদি বা ‘আত্মসত্তার রহস্যাবলী’ শীর্ষক দ্বিপদী কাব্যে তিনি এ বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে:
....চিনির মত মিষ্টি ভাষা হিন্দি যদিও
ফার্সি ভাষার বাকরীতি সুমিষ্ট তার চেয়েও।

যদিও উর্দু কবিতায় ফার্সি শব্দ ও বাগধারা এবং কল্পরীতির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে, তা সত্ত্বেও ইকবাল তার চিন্তাধারা প্রকাশের জন্য ফার্সি ভাষাকেই বেশি উপযোগী মনে করেছেন। ভারত উপমহাদেশে ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের  বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হিসেবে আল্লামা ইকবাল ফার্সি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমকে বেছে নেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারেননি। ফলে ইকবাল তার কবিতার প্রায় দুই তৃতীয়াংশই লিখেছেন ফার্সি ভাষায়।
অন্য কথায় আল্লামা ইকবাল তার কবিতার ১২ হাজারেরও বেশি পঙক্তির মধ্যে প্রায় ৭ হাজার পঙক্তি রচনা করেছেন ফার্সি ভাষায় এবং তার দশটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ছয়টি গ্রন্থ লিখেছেন ফার্সিতে। ইকবাল মাত্র তিনটি কাব্য- গ্রন্থ লিখেছেন উর্দুতে। আর তার সর্বশেষ কাব্য-সংকলন ও তার মৃত্যুর পর  প্রকাশিত ‘আর্মাগানই হিজাজ’ বা ‘হিজাজের সওগাত’ লিখেছেন অংশত ফার্সি ও উর্দু ভাষায়।

ইকবালের প্রথম কাব্য-সংকলন ‘আসরারই খুদি’বা ‘আত্মসত্তার রহস্যাবলী’ শীর্ষক দ্বিপদী কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। তিনি ফার্সিতে কেনো কবিতা লিখছেন?- এ প্রশ্ন তাকে করা হয়েছে বহুবার। ইকবাল জবাবে বলতেন, তিনি এক্ষেত্রে অসহায়, কারণ বেশিরভাগ ভাব বা ভাবনাই তার মাথায় আসতো ফার্সিতে!
আল্লামা ইকবালের  আধ্যাত্মিক প্রেরণার উৎস ছিলেন ফার্সি মরমি কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি। আর রুমির বিশ্ববিশ্রুত কাব্য ‘মাসনাভিয়ে রুমি’র স্টাইলই ছিল ইকবালের কবিতার মডেল। স্বদেশেই তথা ভারতেই ফার্সি কবিতা-রাজ্যের আরো কয়েকজন সম্রাটের কবিতা খুব গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন ইকবাল। 
ইকবাল ‘জাবুরই আজম’ বা ‘পারস্যের জাবুর’ শীর্ষক কাব্যে অত্যন্ত গর্বভরে ঘোষণা করেছেন যে,

আমাকে দেখো, পাবে না ভারতে আমার মত  কাউকে আর
ব্রাক্ষ্মনের সন্তান হয়েও  আমি বুঝি রহস্য রুম ও তাব্রিজের।
উল্লেখ্য, আল্লামা ইকবালের পূর্বপুরুষরা ছিলেন কাশ্মিরি ব্রাক্ষ্মন।
 
‘পায়ামই মাশরেক বা প্রাচ্যের বার্তা’ শীর্ষক কবিতায় ইকবাল শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিশ্রুত ইরানের শহর শিরাজের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন এভাবে:
দেহ আমার ফুল কাশ্মিরি বাগিচার
হৃদয় আমার হিজাজের ঘর, সুর মম শিরাজের।
ইকবালের দু’টি বড় আশা বা স্বপ্ন ছিল। এর একটি ছিল হজ করতে হিজাজে যাওয়া এবং অন্যটি হল ইরানে সফর করা। তার এ দুটি স্বপ্ন কখনও বাস্তবায়িত হয়নি। 

ইরান ও ইরানিদের প্রতি গভীর ভালবাসা আর মমত্ববোধে ভরপুর ইকবালের বিশেষ কাব্য ‘জাবুরে আজম বা পারস্যের জাবুর’ ইকবালকে ইরানিদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন দিয়েছে। এ কবিতায় ইকবাল ইরানিদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যতের আশার বাণী শুনিয়েছেন। ইকবাল তার দূরদৃষ্টির মাধ্যমে দেখতে পেয়েছিলেন যে ইরানে এমন এক মহাপুরুষ ও ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটবে যিনি মানুষকে মুক্ত করবেন দাসত্ব আর দুঃখ-বঞ্চনার শৃঙ্খল থেকে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন:  

অবশেষে আসবেন সেই মানুষ মুক্ত করতে
তাদেরে যারা বন্দি হয়ে আছে দাসত্বের কঠিন শৃঙ্খলে
বন্দিশালার দেয়ালের জানালায় আমি যেন সবই দেখছি।

ইকবালের এই ভবিষ্যদ্বাণী মরহুম ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বিপ্লব কেবল ইরানি জাতিকে নয় একইসঙ্গে গোটা মানবজাতিকে মুক্তির দিশা দিয়ে যাচ্ছে।  #

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/ ২২