ইরানময় নওরোজের আমেজ
(last modified Thu, 24 Mar 2016 13:15:58 GMT )
মার্চ ২৪, ২০১৬ ১৯:১৫ Asia/Dhaka
  • ইরানময় নওরোজের আমেজ

‘নও’ এবং ‘রোজ’ এই দুইয়ে মিলে নওরোজ। ফার্সি ভাষায় নও মানে নতুন আর রোজ মানে দিন। কিন্তু ইরানে নওরোজ একটি পরিভাষা। এর অর্থ হলো বছরের প্রথম দিন। নববর্ষ কিন্তু নয়। নববর্ষকে ফার্সিতে বলে ‘সলে নোও’। আর ওই নতুন বছরের প্রথম দিনগুলোকে বলে নওরোজ। ইরানিদের সবচেয়ে বড় আনন্দের দিনগুলো নববর্ষের এই প্রথম কয়েকটি দিন। চমৎকার আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয় বছরের এই বিশেষ দিনগুলো।

 

ইরানে যে-কোনো উৎসব আনন্দকেই ঈদ বলে অভিহিত করা হয়। নওরোজও সেই অর্থে ঈদ,সবচেয়ে বড় ঈদ। ‘ঈদে নওরোজ’ আসার আগেভাগেই সমগ্র ইরানজুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। যে-কোনো উৎসব আনন্দেই নতুন জামা-কাপড় পরা আর সুগন্ধি ব্যবহার করা সাধারণ একটা নিয়ম। সুতরাং বাজার-ঘাট জমজমাট হয়ে ওঠে এ সময়। কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। সবাই নতুন নতুন জামা-কাপড় কেনার জন্য বাজারে ভিড় জমায়। নওরোজের মাসখানেক আগে থেকেই নির্দিষ্ট শপিং মলগুলোর বাইরেও বিভিন্ন স্কোয়ারে কিংবা জনবহুল স্পটগুলোতে ভ্রাম্যমাণ হাট বসে। নওরোজের পূর্বরাত পর্যন্ত এই বাজার বা হাটগুলো কোলাহলমুখর থাকে। নতুন জামা-কাপড় কিংবা নতুন জিনিসপত্রের প্রভাবে জীবনও ভরে ওঠে নতুন আশা আর উদ্দীপনায়।

 

নতুন আশা ও উদ্দীপনার প্রতীক হলো নবীন সবুজ। এই প্রতীককে বাস্তব রূপ দেওয়া হয় গম কিংবা ডাল ভিজিয়ে চারা তৈরির মধ্য দিয়ে। ঘরে ঘরে এই সবুজের আয়োজন সত্যিই অবাক করার মতো। একটা সময় প্রায় সবাই চারাগাছ তৈরির চেষ্টা করতো। আজকাল অবশ্য হাটে-বাজারে সবখানেই এই সবুজ চারাগাছ বিক্রি হয়। ইরান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি দেশ। কী ঘরে কী বাইরে-সবখানেই তারা পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। বিশেষ করে ঘরের ভেতরটা তকতকে ঝকঝকে করে রাখা ইরানের একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। নওরোজকে সামনে রেখে এই পরিচ্ছন্নতার মাত্রা আরেকটু বেড়ে যায়। সপ্তা দুয়েক আগে থেকেই ঘরদোর পরিষ্কারের হিড়িক লেগে যায়। ঘরের জিনিসপত্র বের করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়। অতিথিদের বরণ করার জন্য প্রস্তুত করা হয় ঘরগুলোকে। ফার্সিতে এই অভিযানের একটা পরিভাষা আছে-‘খনে থেকনি’। এই খনে থেকনি নওরোজের আগেই করে ফেলা হয়।

 

নওরোজের অন্যতম রেওয়াজ হলো ‘হাফত সিন’ সাজানো। টেবিলে কিংবা বড়ো ট্রে-তে এই হাফত-সিন সাজানো হয়। ‘হাফত’ মানে সাত আর ‘সিন’ হলো ফার্সি একটি বর্ণ। অর্থাৎ এই সিন বর্ণ দিয়ে শুরু সাতটি বস্তু টেবিলে সাজানোকেই হাফত সিন বলা হয়। এক গবেষণায় বলা হয়েছে ‘সাত’ সংখ্যাটি পবিত্র। তাই সিন দিয়ে শুরু সাতটি পবিত্র জিনিস সাজানো হয় টেবিলে। বলা হয়ে থাকে যে, আসমান সাতটি আবার জমিনও সাতটি। তাই সাত সংখ্যাটি পবিত্র। বর্ষ বরণের মুহূর্তটাতে কেউ যদি কুরআন থেকে সিন দিয়ে শুরু সাতটি আয়াত তিলাওয়াত করে তাহলে আসমানি যমিনি সকল বালা-মুসবৎ থেকে সে সুরক্ষিত থাকবে। হাফত সিনের একটি উদাহরণ এরকম: সোমগ, সির, সানজেদ, সামানু, সেক্কে, সিরকা এবং সাবজি।

 

নওরোজ উৎসবের কিছু রীতি প্রথা আছে। এগুলোর একটি হলো জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যে সময়টাকে নির্ধারণ করে দেন বর্ষ শুরুর হিসেব নিকেশ করে, সেই মুহূর্তটাতে নববর্ষের দস্তরখানে পরিবারের সকল সদস্য উপস্থিত থাকে। নতুন পোশাক আশাক পরে সবাই একত্রিত হয়। পরিবারে মা যদি থাকেন তাহলে তিনি এসফান্দের ধোঁয়া ছড়িয়ে দেন। এসফান্দ হলো ধূপের মতো ধোঁয়া ছড়ানো এক ধরনের বিচি। একটা পাত্রে কয়লা জ্বালিয়ে ওই বিচিগুলো ছড়িয়ে দিলে ধোয়া বের হয়। এই ধোঁয়া বায়ু দূষণ রোধে খুবই কার্যকরী বলে বলা হয়ে থাকে। ইরানে এই এসফান্দের ধোঁয়া দেয়াকে খুবই পবিত্র মনে করা হয়। রোগ-জীবাণু থেকে মুক্তির লক্ষ্যেও এসফান্দের ধোঁয়া দেয়া হয়। তো মা বর্ষবরণ মুহূর্তে এই ধোঁয়া ছড়ান।

 

ঘরের অন্য যে-কোনো একজন সদস্য মোমবাতি জ্বালায় আর বাবা থাকলে তিনি কুরআন তিলাওয়াত করেন। এই রীতিগুলোর একেকটা দর্শন আছে। যেমন মা এসফান্দের ধোঁয়া দিয়ে হিংসুকের দৃষ্টি থেকে সবাইকে দূরে রাখার আয়োজন করেন। মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘর এবং জীবনকে আলোকিত করে তোলেন। কেবল তাই নয় এর আরেকটি অর্থ হলো পরিবারের মুরব্বিদের উপস্থিতিই হলো মোমবাতির উজ্জ্বলতার মতো। সেই মুরব্বিদের অস্তিত্বের মোমবাতি নি:সরিত আলো দিয়ে নিজেদের বাসাকে আলোকিত করে তোলার চেষ্টা করেন। সেইসঙ্গে কুরআন পড়ে পরিবারের সবার অন্তরকে বছরের শুরুতেই আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট ও রুজু করার চেষ্টা চালানো হয়। আর কুরআনের মালিকের কাছে প্রার্থনা করা হয় তিনি যেন পরিবারের সাহায্যে আগের মতোই সদয় থাকেন।

 

নওরোজের দস্তরখানে আরও কিছু জিনিস দেখা যায়। যেমন সেক্কে মানে ধাতব মুদ্রা বা কয়েন, ধান, পানি, লাল রঙের মাছ, আয়না ইত্যাদি। সেক্কে হলো কল্যাণ, মঙ্গল ও বরকতের প্রতীক, ধানও প্রাচুর্য এবং বরকতের প্রতীক, পানি হলো পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা এবং আলোর প্রতীক, লাল মাছ হলো সৌভাগ্যের নিদর্শন আর আয়না হলো ম্লানিমা বা বিষন্নতা থেকে মুক্তির প্রতীক। বর্ষবরণ শেষে পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে মুখে চুমো দিয়ে আন্তরিক অভিনন্দন জানায় এবং বছরটি যেন বরকতপূর্ণ হয় সেই কামনা করে। সবশেষে দোয়া করা হয়। বর্ষবরণের দোয়া নওরোজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ।

 

পরিবারের যারা পার্থিব এই জগত থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন তাদের কবর জিয়ারত করাও নওরোজ সংস্কৃতির অংশ। বর্ষবরণের দস্তরখানে বসেও এই যিয়ারত করা যায়। তবে অনেকেই যিয়ারতকে গুরুত্ব দিয়ে কবরস্তানেই বর্ষবরণের দস্তরখান সাজায়। কেউবা শহীদদের মাজারে কিংবা পবিত্র স্থানগুলোতেও বর্ষবরণের আয়োজন করে। বর্ষবরণের সময় ‘ঈদি’ মানে ঈদের বখশিস দেয়ার প্রচলন আছে ইরানে। সেইসঙ্গে আত্মীয় স্বজন পবিরার পরিজনদের দেখতে যাওয়ারও রীতি আছে। এই সাক্ষাতে ঈদিও দেয়া হয়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি ছাড়াও বিপদগ্রস্ত, দুস্থজনদেরও দেখতে যাওয়ার নিয়ম আছে নওরোজে।

 

নওরোজের প্রথম দিন থেকেই এই পালা শুরু হয়,চলে সেই তেরতম দিন পর্যন্ত। তেরতম দিন নওরোজের আনুষ্ঠানিকতার শেষ দিন। এই দিনকে বলা হয় ‘সিজদাহ বেদার’। আজকাল প্রকৃতি দিবস নামেও এই দিনটিকে অভিহিত করা হয়।#