উত্তরায় গার্ডার দুর্ঘটনা:
ক্রেন চালাচ্ছিলেন সহকারী, চালকেরও ছিল না লাইসেন্স: র্যাব
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জানিয়েছে, রাজধানীর উত্তরায় প্রাইভেটকারের ওপর যে ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে একই পরিবারের পাঁচ জন নিহত হয়েছে, সে ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী। তাঁর নাম রাকিব হোসেন (২৩)। ওই ব্যক্তির ক্রেন চালানোর লাইসেন্স ছিল না।
আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গার্ডারচাপায় পাঁচ জন নিহতের ঘটনায় এরই মধ্যে ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এর মধ্যে রাকিব ও ক্রেনের মূল চালক আল আমিন হোসেনও রয়েছেন। নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মীসহ ১০ জনকে রাজধানীর জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, কালসী, সাভার এবং গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- আল আমিন হোসেন (২৫), রাকিব হোসেন (২৩), মো. রুবেল (২৮), মো. আফরোজ মিয়া (৫০), মো. জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), মো. ইফতেখার হোসেন (৩৯), আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), তোফাজ্জল হোসেন (৪২), রুহুল আমিন মৃধা (৩৩) ও মঞ্জুরুল ইসলাম (২৯)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা দুর্ঘটনায় তাঁদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব দাবি করেছে, ‘ক্রেনের মূল চালক আল আমিন। তাঁর হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালানোর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। দুই থেকে তিনটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করার পর ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। অন্যদিকে, রাকিব তিন মাস আগে এ প্রকল্পের ক্রেন চালকের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর ক্রেন চালানোর কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার দিনে আল আমিন ও রাকিব দুপুর ২টা থেকে ক্রেন চালানো শুরু করেন। আর দুর্ঘটনার সময় রাকিব ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘একটি গার্ডার স্থাপন শেষে দ্বিতীয় গার্ডার স্থাপনের সময় ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের গার্ডার উত্তোলনের জন্য ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারায়। পরে গার্ডারটি প্রাইভেটকারের ওপর ছিটকে পড়ে। আর এতেই ঘটে দুর্ঘটনা। রাকিব যখন ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন, তখন মূল চালক আল আমিন ক্রেনের বাইরে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পর আল আমিন ও রাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামক একটি প্রতিষ্ঠান। এর স্বত্বাধিকারী গ্রেফতার হওয়া মো. ইফতেখার হোসেন ও হেড অব অপারেশন আজহারুল ইসলাম মিঠু। ভারী যন্ত্রপাতি ইফসকনের কাছে বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিকম্যান আফরোজ ও রুবেল এবং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি’র সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলীকে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের এবং হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিজিজিসি’র প্রকিউরমেন্ট অফিসার মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেফতার করা হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ইফসকন কোম্পানি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিট পায়। গার্ডার বহনের ক্রেন ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে না থাকায় বিল্ড ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠান থেকে অপারেটর ও হেলপারসহ ক্রেনটি মাসিক চুক্তিতে ভাড়া নেয়। ইফসকনের স্বত্বাধিকারী গ্রেফতার হওয়া ইফতেখার ও হেড অব অপারেশন মিঠু অপারেটরদের দক্ষতা ও যোগ্যতা এবং ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারী গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। এ ছাড়া গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না।
র্যাব জানায়, দুর্ঘটনার দিন ভারী গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী স্থাপন ও পর্যাপ্ত ট্রাফিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হওয়া সত্ত্বেও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ডিএমপি ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েছে কাজ চলেছে।
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, দুর্ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে। এখানে আর কারও কোনো গাফিলতি রয়েছে কি না সেটা দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া যাদের যোগ্যতা নেই তারা কীভাবে এখানে কাজ করছেন, কীভাবে তাদের নিয়োগ দেওয়া হলো সে বিষয়টিও খুঁজে দেখা হচ্ছে।
গত ১৫ আগস্ট সোমবার বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর উত্তরার জসীমউদ্দীন এলাকায় ক্রেন থেকে বিআরটি প্রকল্পের ভায়াডাক্ট পড়ে গেলে এর নিচে একটি প্রাইভেটকার চাপা পড়ে। এতে ওই প্রাইভেটকারে থাকা ৫ জন মারা যান। গাড়িতে থাকা নবদম্পতি রেজাউল করিম হৃদয় (২৪) ও রিয়া মনি (২১) আহত হলেও মারা যান হৃদয়ের বাবা মো. রুবেল মিয়া (৬০), রিয়া মনির মা মোছা. ফাহিমা (৩৭), খালা ঝর্ণা বেগম (২৬) এবং খালাতো ভাইবোন জান্নাতুল (৬) ও মো. জাকারিয়া (৪)।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৮