রায়িসির বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন; যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ!
https://parstoday.ir/bn/news/iran-i137824-রায়িসির_বর্ণাঢ্য_কর্মময়_জীবন_যেন_শেষ_হয়েও_হলো_না_শেষ!
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে শহীদ হয়েছেন। তার সাথে শহীদ হয়েছেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। 
(last modified 2025-09-11T14:06:22+00:00 )
মে ২০, ২০২৪ ১৬:৩৮ Asia/Dhaka
  • সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি
    সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে শহীদ হয়েছেন। তার সাথে শহীদ হয়েছেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। 

তাদের এই শাহাদাতের ঘটনায় ইরান জুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এরমধ্যে প্রস্তুতি চলছে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং তার অন্যতম সহচরদের দাফন কাফনের। শুধু ইরান নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শোক নেমে এসেছে। শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছেন বিভিন্ন দেশের নেতা।

১৯৬০ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাসে ইরানের পবিত্র মাশহাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম রায়িসি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি দেশের প্রধান বিচারপতি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইরানের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এই সময় তিনি ইরানের বিচার বিভাগে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং মানবিক ভূমিকা পালন করেন যার কারণে সারা দেশে বিচারপতি হিসেবে তিনি প্রশংসিত হন। ২০১৪ সালে তিনি ইরানের অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। 

এরপর রায়িসি ইরানের পবিত্র মাশহাদ নগরীর ইমাম রেজা (আ) এর মাজারের কাস্টোডিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি মাজারে এমন কিছু কাজ করেন যা এর আগে কখনোই করা হয়নি। 

২০১৯ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইব্রাহিম রায়িসিকে দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। রায়িসির জীবনকালে এটি ছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। 

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রায়িসি

প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের পরপর রায়িসি দেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত প্রশংসনীয় সব উদ্যোগ নেন এবং নারীর অধিকার ও পারিবারিক সহিংসতা রোধের বিষয়ে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেন। 

প্রধান বিচারপতি হিসেবে অত্যন্ত প্রশংসার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালন করার সময় রায়িসির জনপ্রিয়তা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। মূলত এর মধ্য দিয়েই তার রাজনৈতিক জীবনের নতুন অধ্যায় খুলতে শুরু করে। 

২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান প্রার্থী এবং এ সময় দেশ ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মুসলিম বিশ্বে তার কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ওই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির বিপরীতে তিনি দ্বিতীয় অবস্থানে থাকেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ভোট পান দুই কোটি ৩৫ লাখ এবং ইব্রাহিম রায়িসি ভোট পান ১ কোটি ৫৭ লাখ। 

কিন্তু ২০২১ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন করতে এসে বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করেন। এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি চার বছরের জন্য দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের ম্যান্ডেট পান।

ওই নির্বাচনে মোট ভোট পড়ে দুই কোটি ৮৯ লাখ যার মধ্যে সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি পান এক কোটি ৭৯ লাখ। এই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ২০২১ সালে ৩ আগস্ট থেকে দেশের অষ্টম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি দায়িত্ব পালন শুরু করেন। 

প্রেসিডেন্ট রায়িসি যখন দায়িত্ব পালন শুরু করেন তখন ইরান বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল। তারমধ্যে যেমন ছিল মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জন্য অর্থনৈতিক সংকট, তেমনি ছিল দুর্নীতির প্রশ্ন।

২০২১ সালের নির্বাচনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ছিল তার নির্বাচনী প্রচারণা প্রধান বিষয়বস্তু।

রায়িসির ছবি হাতে ইরানি নারীরা

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি ইরানের যুব সমাজকে দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে প্রশংসা করেন এবং অর্থনীতির জন্য ‘চালিকা শক্তি’ বলে অভিহিত করেন। এ সময় তিনি বেকারত্বকে যুব সমাজের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

সর্বোপরি, রায়িসি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংশোধন, দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক জড়তা মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। এর পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি একক অঙ্কের স্তরে নামানোর প্রতিশ্রুতি দেন। 

প্রেসিডেন্ট রায়িসি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নস্যাৎ করতে এবং ইরানের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নতির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, "নিষ্ঠুর" নিষেধাজ্ঞাগুলো অপসারণ করা তার প্রশাসনের জন্য একটি "দায়িত্ব" হবে, যা সক্রিয় অর্থনৈতিক-কূটনীতি এবং প্রতিবেশী-বান্ধব নীতির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। প্রেসিডেন্ট রায়িসি ইরানের বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ করে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আমেরিকা ও ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সাথে আলোচনায় একটি দৃঢ় এবং বাস্তববাদী অবস্থান গ্রহণ করেন।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে চুক্তিটি লাইনচ্যুত করেছিলেন তা রক্ষা করার জন্য ইব্রাহিম রায়িসির মেয়াদ নতুন আলোচনার সাক্ষী ছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অপসারণে মার্কিন বিলম্বের কারণে সেই প্রচেষ্টা আবার বাধাগ্রস্ত হয়।

এগুলোর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত স্পর্শকাতর ঘটনাবলীতে রায়িসি সরকারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত শক্ত এবং প্রশংসনীয়। ইরানের ইতিহাসে রায়িসির আমলেই ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাথে ইরানের সরাসরি সীমিত মাত্রায় সামরিক সংঘাত হয় যার প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থন ছিল। এজন্য রায়িসি সরকার সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসা পায়। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাবলীতে রায়িসি সরকারের ভুমিকা ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল ও গৌরবময়।

গতকাল (রোববার) ১৯ মে জনতার এই প্রেসিডেন্ট ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আজারবাইজান প্রদেশে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় শহীদ হন। এর মধ্যদিয়ে অবসান ঘটে বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী এক প্রেসিডেন্টের দুনিয়ার সফরের। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন তারই অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান।#

পার্সটুডে/এসআইবি/এমএআর/২০