ইলাম প্রদেশ: ইরানের জ্বালানি সম্ভারে ভরপুর এক লুকানো ভাণ্ডার
-
ইলাম প্রদেশ: ইরানের জ্বালানি সম্ভারে ভরপুর এক লুকানো ভাণ্ডার
ইলাম, জনসংখ্যার দিক থেকে ইরানের সবচেয়ে ছোট প্রদেশ হলেও, এটি দেশের তৃতীয় বৃহত্তম তেল রিজার্ভ এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের অধিকারী। ইরাক সীমান্তঘেঁষা এই প্রদেশটি ধীরে ধীরে জ্বালানি উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে—বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল উত্তোলন ও প্রাকৃতিক গ্যাস উন্নয়নের মাধ্যমে।
বর্তমানে ইলামে ৪ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে, যেখানে বেসরকারি খাতকেও স্বাগত জানানো হচ্ছে। এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো জ্বালানি অবকাঠামোকে আধুনিক ও বিস্তৃত করা।
ভূগোল ও জ্বালানির সম্ভাবনা: ইরাকের জন্য একটি গ্যাস হাব
প্রাকৃতিক সম্পদ ও সীমান্তবর্তী অবস্থানের কারণে ইলাম প্রদেশটি ইরাকে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির হাব হয়ে উঠার সম্ভাবনা রাখে। কারণ ইরাকের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বড় একটি অংশ ইরানি গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
অর্থনীতি ও জনসংখ্যা: ক্ষুদ্র কিন্তু সম্ভাবনাময়
২০১৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, প্রদেশটির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫.৮ লাখ, যার মধ্যে ৫৫ হাজারের বেশি কৃষক এবং ৩,৩৫০ জন শিল্প শ্রমিক ছিলেন। ইলামের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর, পশুপালন ও সীমিত শিল্প কার্যক্রমের ওপর দাঁড়িয়ে। জিডিপিতে এর অবদান ছিল প্রায় ১ শতাংশ, যা জাতীয়ভাবে ২৬তম স্থান।
ইলামের জ্বালানি রত্নভাণ্ডার
প্রদেশটি ১৭ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ধারণ করে, যা ইরানের মোট রিজার্ভের ১১ শতাংশ—খুজেস্তান ও বুশেহর-এর পর তৃতীয় বৃহত্তম। গ্যাস মজুতে ইলামের অংশ ১৪ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার, যা ইরানের মোট রিজার্ভের ৬ শতাংশ—দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রের পর।
প্রধান তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে: চেশমেহ খোশ, ডানা ও দানান, আজার (যেটি ইরাকের বাদরা ক্ষেত্রের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত) এবং বিজার ক্যানিয়নে সম্ভাব্য গ্যাস মজুত

চেশমেহ খোশ: ইলামের প্রধান তেলক্ষেত্র
প্রতিদিন ইলামে প্রায় ১.৫৪ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন হয়, যার অধিকাংশ আসে চেশমেহ খোশ থেকে। এটি ১৯৬৪ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং ১৯৭৫ সাল থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়।
চেশমেহ খোশ থেকে আহর ভাজ-৩ তেল শোধনাগারে ১৫৩ কিমি পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল পাঠানো হয়, সেখান থেকে বুশেহরের খার্গ দ্বীপে তা রপ্তানি বা পরিশোধনের জন্য পাঠানো হয়।
উন্নয়ন প্রকল্প ও বিনিয়োগ
ডানা ও দানান প্রকল্পে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে (জাতীয় উন্নয়ন তহবিল-NDFI)। দানান ক্ষেত্রের উৎপাদন ৮,০০০ ব্যারেল থেকে ১৯,০০০ ব্যারেলে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ চলছে।
আজার ক্ষেত্র (যা ২০১৭ সাল থেকে চালু) বর্তমানে ৬৫,০০০ ব্যারেল দৈনিক উৎপাদন করছে।
বিজার ক্যানিয়ন-এ ২০১৯ সালে শুরু হওয়া একটি তিন বছর মেয়াদি অনুসন্ধান প্রকল্প গোপন গ্যাস রিজার্ভের খোঁজে চলছে।

গ্যাস ও শক্তি পরিকাঠামো
ইলাম গ্যাস শোধনাগার, ২০০৭ সাল থেকে চালু, প্রদেশের গ্যাস খাতে প্রধান কেন্দ্র। এটি ২৫০ হেক্টর জমিতে অবস্থিত এবং তাঙ বিজার ক্ষেত্র থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে। এখানে প্রতিদিন উৎপন্ন হয়:
- ৪০০ টন ইথেন
- ৬৭০ টন তরল গ্যাস (এলপিজি)
- ২৫০ টন সালফার
- ৪,০০০ ব্যারেল গ্যাস কনডেনসেট
ইলাম থেকে উৎপাদিত গ্যাস সারা দেশের গ্যাস নেটওয়ার্কে যুক্ত, তবে অবকাঠামোগত দিক থেকে এটি এখনো পারস্য উপসাগরীয় উপকূলীয় কেন্দ্রগুলো (যেমন আসালুয়েহ, আবাদান, বান্দার ইমাম) এর তুলনায় কম উন্নত।
রপ্তানি ও কৌশলগত অবস্থান
২০২৪ সালে ইলাম প্রদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১.১৬৯ বিলিয়ন ডলার, যার বড় অংশই জ্বালানিনির্ভর। ৪২৫ কিমি দীর্ঘ ইরাক সীমান্ত থাকায় ইলামকে একটি সম্ভাব্য জ্বালানি রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

ইরাককে গ্যাস সরবরাহ: এক কৌশলগত সম্পর্ক
ইরান প্রতিদিন ইরাককে ৫০ মিলিয়ন ঘনমিটার পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করে, যার পরিমাণ চাহিদার ভিত্তিতে ওঠানামা করে। এই গ্যাস ইরাকের বিদ্যুৎ চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করে এবং বিদ্যুৎ সংকট রোধে ভূমিকা রাখে।
২০২৪ সালে স্বাক্ষরিত ৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি অনুযায়ী, যার বার্ষিক মূল্য ৬ বিলিয়ন ডলার, ইরান থেকে ইরাকে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা
ইলাম শুধু জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এখানে রয়েছে সেইমারে বাঁধ, যেখানে ৩টি ১৬০ মেগাওয়াট ফ্রান্সিস টারবাইন জেনারেটর রয়েছে—মোট ৪৮০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা। ইলামের আবহাওয়া ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য—বিশেষ করে উচ্চ সৌর বিকিরণ ও অনুকূল বাতাসের জন্য সোলার ও উইন্ড ফার্ম গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এছাড়া জলবিদ্যুৎ ও বায়োমাস সম্পদও রয়েছে, যা জ্বালানি বৈচিত্র্য এবং বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।#
পার্সটুডে/এমএআর/৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।