নাকশে জাহান স্কয়ার: ইরানের শক্তি, শিল্প ও জীবনের এক মহিমান্বিত প্রতিচ্ছবি
https://parstoday.ir/bn/news/iran-i152078-নাকশে_জাহান_স্কয়ার_ইরানের_শক্তি_শিল্প_ও_জীবনের_এক_মহিমান্বিত_প্রতিচ্ছবি
পার্সটুডে: নাকশে জাহান স্কয়ার (বিশ্বের প্রতিচ্ছবি) ইস্ফাহান শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বিশাল ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান, যা বিশ্বের বৃহত্তম নগর চত্বরগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে পরিচিত এবং এটি ইরানি ও ইসলামী স্থাপত্যের একটি অতুলনীয় শ্রেষ্ঠকর্ম।
(last modified 2025-09-17T12:42:57+00:00 )
সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫ ১৮:৩৩ Asia/Dhaka
  • নাকশে জাহান স্কয়ার: ইরানের শক্তি, শিল্প ও জীবনের এক মহিমান্বিত প্রতিচ্ছবি

পার্সটুডে: নাকশে জাহান স্কয়ার (বিশ্বের প্রতিচ্ছবি) ইস্ফাহান শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বিশাল ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান, যা বিশ্বের বৃহত্তম নগর চত্বরগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে পরিচিত এবং এটি ইরানি ও ইসলামী স্থাপত্যের একটি অতুলনীয় শ্রেষ্ঠকর্ম।

ইতিহাস ও স্থাপত্য

১৭শ শতকের শুরুতে সাফাভি রাজবংশের 'শাহ আব্বাস প্রথম'-এর আদেশে এই স্কয়ার নির্মিত হয়। এটি দ্বি-স্তরবিশিষ্ট খিলানযুক্ত বারান্দা দ্বারা বেষ্টিত। এর চারদিকে রয়েছে চারটি মহিমান্বিত স্থাপনা। এগুলো হল: পূর্বে শেখ লুৎফুল্লাহ মসজিদ, পশ্চিমে আলী কাপু প্রাসাদ, উত্তরে কায়সারিয়া গেট এবং দক্ষিণে ইমাম মসজিদ।

এই নকশা নিখুঁতভাবে সাফাভি যুগের নগর পরিকল্পনা ও শিল্পকলার উৎকর্ষ প্রদর্শন করে। সেই সময়ে এটি ছিল রাজধানী ইস্ফাহানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র। 'নাকশে জাহান' নামে পরিচিত এই স্কয়ার অতীতে 'ময়দান-ই শাহ' নামে খ্যাত ছিল, বর্তমানে এর সরকারি নাম 'ইমাম স্কয়ার'। 

আলী কাপু প্রাসাদ

রাজধানীর নতুন প্রাণকেন্দ্র

১৫৯০-এর দশকে রাজধানী ইস্ফাহানে স্থানান্তরের পর, শাহ আব্বাস প্রথম তার নতুন নগর পরিকল্পনার মূল অক্ষ হিসেবে নাকশে জাহান চত্বরকে নির্বাচন করেন। যেখানে পুরনো শহরের বাজার ছিল 'ময়দান-ই কোহনে', সেখানে নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে রাজশক্তি ও বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে এই স্কয়ার।

১৬০২ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়। একতলা খিলানবিশিষ্ট আর্কেডগুলোর সামনে বারান্দা ছিল, যার পেছনে বিস্তৃত আচ্ছাদিত বাজার স্থাপন করা হয় এবং একাধিক প্রবেশদ্বারের মাধ্যমে এটি রাজকীয় স্কয়ারের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

প্রায় ২০০টি দুইতলা দোকানঘর নির্মিত হয়। নিচতলায় ছিল দুটি বড় দোকান এবং উপরের তলায় চারটি ছোট দোকান—দুটি স্কয়ারের দিকে মুখ করা, বাকি দুটি পেছনে বারান্দাসহ। প্রথমদিকে মেঝে ছিল মার্বেল পাথরের, পরে রঙিন টাইলস ও সজ্জিত পাথর দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়।

পুরোনো বাজার ছিল সাধারণ মানুষের জন্য, কিন্তু নতুন "রাজকীয় বাজার" মূলত সাফাভি দরবার, অভিজাত শ্রেণি ও রাষ্ট্রীয় অতিথিদের প্রয়োজন মেটাত।

আকাশ থেকে তোলা নাকশে জাহান স্কয়ারের ছবি

নগর পরিকল্পনার অনন্য নিদর্শন

৫৬০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৬০ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট এই চত্বর মোট ৯ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। ইরানি শহরগুলোর প্রচলিত সংকীর্ণ কাঠামোর বিপরীতে এই মুক্ত, বিশাল নগরচত্বর ছিল অভিনব। খিলান ও আর্কেডগুলো কেবল বাণিজ্যের স্থানই নয়, বরং শিল্পকর্মের মতোই রঙিন টাইলস ও নকশায় সজ্জিত।

ইমাম মসজিদ বিশেষ কোণে কিবলার দিকে স্থাপিত। এর রঙিন মোজাইক, সুউচ্চ বারান্দা এবং দুটি সুউচ্চ মিনার সাফাভি শিল্পকলার প্রতীক। আলী কাপু প্রাসাদ তার বারান্দা ও সরু স্তম্ভ নিয়ে রাজপ্রাসাদ ও বিখ্যাত চাহারবাগ সড়কের প্রবেশদ্বার ছিল। কাইসারিয়া প্রবেশদ্বার ইস্ফাহানের বৃহৎ বাজারের পথ উন্মুক্ত করত। আর শেখ লুতফুল্লাহ মসজিদ, যা একসময় শাহ পরিবারের ব্যক্তিগত উপাসনালয় ছিল, ইসলামি স্থাপত্যের এক অনন্য রত্ন।

নতুন স্কয়ারের উত্থানের ফলে পুরোনো ময়দান-ই কোহনে বাজার তার গুরুত্ব হারায়। তবুও এটি আজও ২০শ শতকের পূর্ববর্তী ইসলামি বাজারের সেরা নিদর্শনগুলোর একটি।

নাকশে জাহান স্কয়ারের ইমাম মসজিদ

সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনের কেন্দ্র

সাফাভি যুগে নাকশে জাহান ছিল চৌগান খেলা, সামরিক কুচকাওয়াজ ও গণঅনুষ্ঠানের প্রধান কেন্দ্র। দোকানগুলোতে ছিল ব্যবসায়ীর ভিড়, আর বারান্দাগুলো থেকে বাজত সুরের ঝংকার। ভ্রমণকারী যেমন ১৭শ শতকের জ্যঁ শার্দাঁ একে বর্ণনা করেছেন 'বাণিজ্য, শিল্প ও সামাজিক মেলামেশার প্রাণকেন্দ্র' হিসেবে।

আলী কাপু প্রাসাদের বারান্দা সংলগ্ন কক্ষে শাহ আব্বাস বিদেশি প্রতিনিধিদের বরণ করতেন, যা স্কয়ারকে ইরানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেছিল। এককেন্দ্রে ক্ষমতা ও জীবনের বহুমাত্রিক সমন্বয় শাহ আব্বাসের কর্তৃত্ব আরও দৃঢ় করেছিল।

আজকের নাকশে জাহান

আজও নাকশে জাহান স্কয়ার মানুষের মিলনস্থল। এখানে রয়েছে বাগান, ফোয়ারা, সাংস্কৃতিক উৎসব ও সামাজিক আয়োজন।

১৯৭৯ সালে এই স্কয়ারকে তাখত-ই জামশিদ ও চোগা জানবিলের সঙ্গে একত্রে প্রথম ইরানি নিদর্শন হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।#

পার্সটুডে/এমএআর/১৭