ডিসকভার ইরান:
ইস্ফাহান: যেখানে স্মার্ট সিটি প্রকল্প মিশে যায় প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে
ইরানের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ইস্ফাহান শহর আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে শহরটি উচ্চাভিলাষী নগর উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছে।
স্মার্ট সিটি উদ্যোগ ও মেট্রো লাইন থেকে শুরু করে প্রাচীন স্থাপত্য সংরক্ষণ ও ইউনেসকো সুরক্ষা—সবক্ষেত্রেই নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংরক্ষণবিদরা আধুনিকায়ন ও ঐতিহ্য রক্ষার সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছেন।
দ্রুত নগরায়নের মাঝে, ঝলমলে 'আধা জাহান' খ্যাত ইস্ফাহান আজকের শতকে এক বড় প্রশ্নের মুখোমুখি—কীভাবে উন্নয়ন হবে অথচ প্রাচীন, প্রারম্ভিক ইসলামি ও সাফাভি যুগের ঐশ্বর্য মুছে যাবে না।
আকাশে ক্রেনের দৃশ্য আর স্মার্ট সিটি প্রকল্পের ডিজিটাল রূপান্তরের প্রতিশ্রুতির ভেতরেও নগর পরিকল্পনাবিদদের এই ভারসাম্য রক্ষা করতে হচ্ছে—প্রতিটি পুনর্নির্মিত মসজিদে, প্রতিটি নতুন মেট্রো লাইনে, প্রতিটি ইউনেসকো আলোচনায়।
ইরানের নগরায়নের হার ৭৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং পর্যটনের চাহিদার কারণে ইসফাহানের অবকাঠামোতে চাপ পড়ছে।
সংরক্ষণ প্রচেষ্টা
শহরের উচ্চাভিলাষী মেট্রো সম্প্রসারণ (যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৭৫ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত হওয়ার পরিকল্পনা) প্রতিটি ধাপে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উন্মোচন করেছে। তাই নকশা পরিবর্তন করে নাকশে জাহান স্কয়ারের ইউনেসকো সুরক্ষিত এলাকার নিচ দিয়ে টানেলগুলো পুনরায় রুট করতে বাধ্য হচ্ছেন প্রকৌশলীরা।
অন্যদিকে, স্মার্ট সিটি প্রকল্পগুলো—এআই চালিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা থেকে সৌরশক্তি চালিত ওয়াই-ফাই প্লাজা, নান্দনিকভাবে ঐতিহাসিক কেন্দ্রের ফিরোজা গম্বুজ এবং আরবেস্ক মুখভঙ্গির সাথে বৈসাদৃশ্য তৈরি করেছে।
ইস্ফাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ইতিহাসবিদ ড. পারিসা ভাহদাতি সতর্ক করে বলেছেন, "প্রতিটি নতুন উন্নয়নই একটি দাগ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রাখে। কিন্তু স্থবিরতাও কোনও বিকল্প নয়—আমাদের তরুণদের চাকরি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দরকার।"
শহরকে স্থবির না রেখে সংরক্ষণবিদরা তাই অ্যাডাপটিভ রিইউজ পদ্ধতি নিয়েছেন। অনেক সাফাভি ও কাজার যুগের প্রাসাদ ও কারাভানসারাই আজ হোটেলে রূপান্তরিত হয়েছে।
জায়ানদে রুদ নদীর তীরে সাফাভি যুগের খাজু ব্রিজের নিচতলার চা ঘরগুলো এখন ইস্ফাহানি হস্তশিল্প বিক্রির কারিগরদের কো-অপে পরিণত হয়েছে—যা ইউনেসকো প্রশংসা করেছে 'ঐতিহ্যকে অর্থনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখার মডেল' হিসেবে।
ইউনেসকো তালিকাভুক্ত ইমাম মসজিদ ও আলি কাপু প্রাসাদসহ শহরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো সূক্ষ্ম ভারসাম্যের মধ্যে বিদ্যমান। কঠোর সংরক্ষণ আইন বাফার জোনে কোনো পরিবর্তন করতে দেয় না—যা ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা হুইলচেয়ার র্যাম্প বসানোর মতো কাজের সময় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
২০২৩ সালে শহর কর্তৃপক্ষ পুরো সাফাভি নগর কাঠামোকে ইউনেসকো সুরক্ষায় আনার উদ্যোগ নেয়। তবে এই পরিকল্পনা বিতর্কিত, কারণ এতে হাজারো আবাসিক ভবন স্থির হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ আমিরহোসেইন নাজেমি স্বীকার করেন, "ইউনেস্কো মর্যাদা একদিকে যেমন রক্ষাকবচ, তেমনি আবার বিধিনিষেধ আরোপকারী। আমাদের উদ্ভাবনী হতে হয়েছে—যেমন মেট্রো স্টেশনের দেয়ালে ঐতিহ্যবাহী চুনের মোর্টার ব্যবহার করা, যাতে আধুনিক সংযোজনগুলো ঐতিহাসিক কাঠামোর মতো 'শ্বাস নিতে পারে'।"
ইস্ফাহানের ভবিষ্যতের নকশা হয়তো তার অতীতেই নিহিত। 'ইস্ফাহান ২০৩৫' মাস্টারপ্ল্যান নির্দেশ দিয়েছে, ঐতিহাসিক এলাকায় সব নতুন ভবনে স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করতে হবে এবং সাফাভি অনুপাত (উচ্চতার সীমা, অঙ্গন-কেন্দ্রিক নকশা) মানতে হবে।
এমনকি আসন্ন মেট্রো লাইন ৩, যা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ প্রান্তকে যুক্ত করবে, তাতেও ইস্ফাহানের খ্যাতনামা আর্ট স্কুলের কারিগরদের টাইলের কাজ থাকবে।
সূর্যাস্তে সি-ও-সে-পোল ব্রিজের ওপর আলো-ছায়ার খেলা যখন পুনর্নির্মিত পাথরের দেয়াল ও এলইডি-আলোকিত সাইকেল লেনের সাথে মিশে যায়, তখন শহরের এই দ্বৈততা চোখে পড়ে।
এখানে ৪০০ বছরের পুরোনো পানি ব্যবস্থাপনা ভাগাভাগি করছে সৌরশক্তিচালিত জল-সেন্সরের সাথে—যা ইস্ফাহানের সূক্ষ্ম অথচ আশাব্যঞ্জক ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি।
স্মার্ট সিটি প্রকল্প
ইস্ফাহান স্মার্ট সিটি প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছে যানজট, বায়ুদূষণ ও জনসেবা প্রদানের মতো নগর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়। কোভিড-১৯ মহামারি এই প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুততর করেছে।
'সিটি উইথ এ ফিউ ক্লিকস' উদ্যোগ এই পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যেখানে প্রথম প্রজন্মের স্মার্ট সিটি মূলত প্রযুক্তিনির্ভর ছিল, আজকের মডেল অবকাঠামো, জনসম্পৃক্ততা ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে একত্র করছে—যা ইস্ফাহানকে সতর্কভাবে অতিক্রম করতে হবে।
এই প্রকল্প দ্বিতীয় প্রজন্মের স্মার্ট সিটির অন্তর্ভুক্ত, যেখানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম শুধু সেবা দেয় না, বরং নাগরিক অংশগ্রহণও বাড়ায়।
১৫ বছর আগে ডিজিটাইজেশন দিয়ে শুরু হয়ে প্রকল্পটি এখন স্মার্ট সিটি কাঠামোয় রূপ নিয়েছে। এতে বিদ্যমান অবকাঠামো কাজে লাগিয়ে কার্যক্রম সহজ করা হচ্ছে। আইওটি সেন্সর, ট্রাফিক অপ্টিমাইজেশনে এআই, আর একটি কেন্দ্রীয় ডাটা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রকল্পটির আওতায় ১৩৪টি পৌরসেবা অনলাইনে চালু হয়েছে, যাতে সশরীরে অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ও বর্জ্য সংগ্রহের সময়সূচি।
এর প্রভাবও উল্লেখযোগ্য—২০ লক্ষাধিক বাসিন্দা উপকৃত হয়েছে এবং ২০২৩ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ ট্রাফিক যাতায়াত কমেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহজতর অ্যাক্সেস নিশ্চিত করায় এটি সামাজিক সমতাও বাড়িয়েছে।
তবে অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা ও দেশীয় উদ্ভাবনের ওপর নির্ভরশীলতা প্রকল্প সম্প্রসারণে বাধা দিচ্ছে। তবে স্মার্ট সিটি টাস্ক ফোর্সের প্রধান আলি রেজায়ি স্থানীয় গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়।
'ইস্ফাহাননামা' ওয়েবসাইটের মতো প্রকল্পগুলো অগ্রগতির দিক নির্দেশ করে। তবে নগর নকশাবিদরা সতর্ক করেছেন—প্রযুক্তি একাই একটি স্মার্ট সিটি গড়ে তুলতে পারে না। নাগরিক সম্পৃক্ততা, অর্থনৈতিক প্রাণশক্তি ও বুদ্ধিদীপ্ত নগর নকশার সাথে প্রযুক্তিকে পাশাপাশি চলতে হবে।#
পার্সটুডে/এমএআর/২৮