পার্সেপোলিস: পারস্য স্থাপত্য ও প্রকৌশলের এক অনুপম সৃষ্টি
https://parstoday.ir/bn/news/iran-i152978-পার্সেপোলিস_পারস্য_স্থাপত্য_ও_প্রকৌশলের_এক_অনুপম_সৃষ্টি
পার্সটুডে: মারভদাশ্ত সমভূমির বুকে 'কুহ-ই রহমত' বা 'দয়া পর্বতের' পাদদেশে হাখামানেশি যুগের ইরানি শক্তি ও শিল্পকলার চূড়ান্ত নিদর্শন হিসেবে আজও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে পার্সেপোলিসের মহিমান্বিত ধ্বংসাবশেষ।
(last modified 2025-11-11T14:44:42+00:00 )
অক্টোবর ১৩, ২০২৫ ২০:২৯ Asia/Dhaka
  • পার্সেপোলিস: পারস্য স্থাপত্য ও প্রকৌশলের এক অনুপম সৃষ্টি

পার্সটুডে: মারভদাশ্ত সমভূমির বুকে 'কুহ-ই রহমত' বা 'দয়া পর্বতের' পাদদেশে হাখামানেশি যুগের ইরানি শক্তি ও শিল্পকলার চূড়ান্ত নিদর্শন হিসেবে আজও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে পার্সেপোলিসের মহিমান্বিত ধ্বংসাবশেষ।

খ্রিস্টপূর্ব ৫১৮ সালের দিকে দারিয়ুস প্রথম (দারিয়ুস দ্য গ্রেট) এই নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি শুধুমাত্র একটি শহর ছিল না, বরং ছিল এক বিশাল আনুষ্ঠানিক রাজধানী। একটি বিশাল অর্ধ-কৃত্রিম, অর্ধ-প্রাকৃতিক মঞ্চের ওপর নির্মিত এই অবকাঠামোটি নির্মাণ করা হয়েছিল সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ও ঐশ্বরিক অনুমোদিত শাসনের প্রতীক হিসেবে।

ইরানিরা পার্সেপোলিসকে ‘তাখতে জামশিদ’ নামে অভিহিত করে থাকে। এখানে পারস্যের সম্রাটরা শুধু শাসনকাজ পরিচালনা করেননি, আয়োজন করতেন মহাসমারোহের—বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দূতেরা আসত, বহন করত উপঢৌকন। জাঁকজমকপূর্ণভাবে ফার্সি নববর্ষ বা নওরোজ উৎসব হতো এখানে।

মহিমান্বিত সিঁড়ি, বিশাল প্রবেশদ্বার ও উঁচু স্তম্ভবেষ্টিত হলগুলো আজও হাখামানেশি রাজতন্ত্রের মহিমা ও শৃঙ্খলার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেমনটি দারিয়ুস চেয়েছিলেন।

পার্সেপোলিসের ধ্বংসাবশেষে হাঁটলে মনে হয়, পাথর যেন রূপ নিয়েছে এক চিরস্থায়ী ইতিহাসে- যেখানে ক্ষমতা, ধর্মবিশ্বাস এবং বহুজাতিক সংস্কৃতির সমন্বয় একসঙ্গে মিশে গেছে। আলেকজান্ডারের অগ্নিসংযোগের শতাব্দী পরেও এর ঐতিহ্য মানবসভ্যতাকে অনুপ্রাণিত করে চলছে।

পার্সেপোলিস

প্রকৌশল ও স্থাপত্যের বিস্ময়

পার্সেপোলিসের ভিত্তি নির্মাণই ছিল এক প্রকৌশলিক বিস্ময় — প্রকৃতিকে সাম্রাজ্যের  দৃষ্টিভঙ্গির অংশে রূপান্তর করার এক পরিকল্পিত প্রয়াস।

১,২৫,০০০ বর্গমিটার আয়তনের বিশাল এই মঞ্চটি তৈরি করতে একটি পাথুরে শৈলশিরাকে সমতল করা, গর্ত-খাদ মাটি ও ইটের গুঁড়ো দিয়ে ভরাট করা এবং বিশাল, মসৃণভাবে যুক্ত পাথরের স্ল্যাব দিয়ে বারো মিটার উঁচু ধারণকারী দেয়াল নির্মাণের প্রয়োজন হয়েছিল।

এই ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণভাবে পরিকল্পিত- যেখানে ছিল নিখুঁতভাবে নকশা করা ভূগর্ভস্থ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ড্রেন ও কূপ, যা আজও তার কার্যকারিতা বজায় রেখেছে।

পার্সেপোলিসের স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠত্ব বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে এর স্তম্ভ ব্যবস্থায়। হাখামানেশি স্থপতিরা হালকা ছাদ ও কাঠের বিম ব্যবহার করে বিস্তৃত ও খোলা স্থান তৈরি করেছিলেন, যেখানে ১.৬ মিটার ব্যাসের স্তম্ভগুলো প্রায় ২০ মিটার উঁচু হয়ে দাঁড়ায়- একসঙ্গে শক্তি ও সৌন্দর্যের নিখুঁত সমন্বয়ে।

এই স্তম্ভগুলোর মাথায় ছিল হাখামানেশি শিল্পের অন্যতম নিদর্শন- দ্বি-বৃষ বা দ্বি-সিংহ অলঙ্করণ, যেখানে দুটি পশুর সামনের অংশ একে অপরের বিপরীতে স্থাপন করা এবং তাদের ঘাড় একত্রে মিলে ছাদকে সমর্থন করে রাখে।

এই শৈলী ছিল এক সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের ফল। পারস্য ছিল মূল পরিকল্পনাকারী, কিন্তু কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল সাম্রাজ্যের নানা প্রান্তের শিল্পীদের দ্বারা। লিডীয়, আইওনীয়, অ্যাসিরীয়, মিশরীয় ও ব্যাবিলনীয় উপাদান মিলিয়ে তারা এক মহিমান্বিত ও অনন্য “ইরানি সাম্রাজ্যের স্থাপত্যশৈলী” গড়ে তুলেছিলেন।

পার্সেপোলিস

পাথরে লেখা সাম্রাজ্যের ইতিহাস

পার্সেপোলিস শুধু স্থাপত্য নয়, এটি ছিল এক বিশাল পাথরের ক্যানভাস, যেখানে খোদাই করা ভাস্কর্যগুলো সাম্রাজ্যের ভাবধারা ও ঐক্যের গল্প বলেছে।

সবচেয়ে বিখ্যাত এই শিলাচিত্রগুলো দেখা যায় 'আপাদানা প্রাসাদ'-এর সিঁড়ির পাশে। এখানে তিন স্তরে সাজানো আছে পারস্য ও মিডিয়া অভিজাত, সেনা ও দরবারিদের সারি— তাদের মধ্যে কেউ কাঁধে হাত রেখেছে, কেউ হাসছে, যা প্রাচীন রাজদরবারের মানবিক এক ঝলক তুলে ধরে।

অন্য দিকের প্রাচীরে দেখা যায় সাম্রাজ্যের ২৩টি প্রদেশ থেকে আগত উপহারবাহী প্রতিনিধিদল- প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব পোশাক ও উপহারসহ। কেউ এনেছে উট, কেউ মূল্যবান ফুলদানি, কেউ হাতির দাঁত, কেউ আবার রাজকীয় ঘোড়া। প্রত্যেক দলের নেতার হাত ধরে আছেন এক পারস্য বা মিডিয়ান প্রহরী — যা সাম্রাজ্যের ঐক্য ও কর্তৃত্বের প্রতীক।

এই শোভাযাত্রা পৌঁছায় রাজাসনের সামনে- যেখানে রাজা আসীন, মাথার ওপর ছাতা এবং চারদিক থেকে বিশ্বজুড়ে আগত প্রতিনিধিদের অভিবাদন গ্রহণ করছেন।

বারবার দেখা যায় 'সিংহের দ্বারা ষাঁড়কে আক্রমণ করার প্রতীক', যা সময় ও রাজশক্তির চক্রাকার রূপকে নির্দেশ করে। একসময় এই ভাস্কর্যগুলো ছিল রঙিন — লাল, নীল, সোনালি ও মূল্যবান ধাতুর অলংকারে সজ্জিত, যা একে এক জীবন্ত ও জাঁকজমকপূর্ণ মহাকাব্যে রূপান্তর করেছিল।

পার্সেপোলিস

রাজকীয় আচার ও প্রাসাদসমূহ

পার্সেপোলিসের মঞ্চটি ছিল ক্ষমতার এক সুপরিকল্পিত মঞ্চ, যেখানে প্রতিটি স্থাপনা একটি নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করত।

প্রবেশপথ ছিল 'গেট অব অল ল্যান্ডস', যেখানে খোদাই করা বিশাল ডানা-যুক্ত ষাঁড়দ্বয় দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাত। এখানে খোদাই করা শিলালিপি তিনটি ভাষায় ঘোষণা করত — এটি সমগ্র বিশ্বের জাতিগোষ্ঠীর প্রবেশদ্বার।

এর পরেই দাঁড়ায় 'দারিয়ুস ও জারক্সেসের আপাদানা প্রাসাদ'- পুরো কমপ্লেক্সের কেন্দ্রবিন্দু। ৩৬টি স্তম্ভে ভর করে নির্মিত এই বিশাল হলঘরে একসঙ্গে ১০,০০০ অতিথির সমাবেশ সম্ভব ছিল। এখানেই অনুষ্ঠিত হতো সাম্রাজ্যের বৃহত্তম রাজকীয় অনুষ্ঠান।

এরপরে রয়েছে 'তাচারা', অর্থাৎ দারিয়ুসের ব্যক্তিগত প্রাসাদ— মঞ্চের প্রাচীনতম স্থাপনা, যা পরবর্তীকালে অন্যান্য রাজপ্রাসাদ ও রাজকীয় সমাধির অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আরও ভেতরে 'ট্রাইপিলন বা কেন্দ্রীয় প্রাসাদ', যেখানে খোদাই করা আছে রাজা ও যুবরাজকে, যাদের সিংহাসন বহন করছে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতির প্রতিনিধি।

সবচেয়ে বড় হলটি হলো 'থ্রোন হল বা শতস্তম্ভ হল', যা জারক্সেস শুরু করেন এবং আর্টাক্সার্কেস প্রথম সম্পন্ন করেন। এটি ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাসাদ, যেখানে রাজকীয় সভা অনুষ্ঠিত হতো আরও ঘনিষ্ঠ পরিসরে।

এসব প্রাসাদ, দরজা ও উঠোনের বিন্যাস এক প্রতীকী স্থাপত্য রীতিতে সাজানো ছিল, যেখানে চলাচলের দিক, উচ্চতা ও স্থানবিন্যাস রাজকীয় শ্রেণিবিন্যাস ও ক্ষমতার স্থায়িত্বকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরত।

পার্সেপোলিস

বিশ্ব ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার

পার্সেপোলিস আজ ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান — প্রাচীন সভ্যতার অনন্য সাক্ষ্য হিসেবে। এর গুরুত্ব কেবল স্থাপত্য বা আকারে নয়, বরং হাখামানেশি সাম্রাজ্যের শাসনদর্শনের প্রমাণ হিসেবে— যেখানে একটি বহুজাতিক সাম্রাজ্য তার জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করত এবং সেই আদর্শই প্রতিফলিত হয়েছে পার্সেপোলিসের শিল্প ও স্থাপত্যে।

স্থাপনাগুলো আজও মূল অবস্থান, উপাদান ও পরিবেশে অক্ষুণ্ণ— কোনো আধুনিক পুনর্নির্মাণের জটিলতা ছাড়াই। সংরক্ষণের কাজগুলো ঐতিহ্যগত কৌশল ব্যবহার করে সম্পন্ন হয়।

পার্সেপোলিসের মূল কাঠামো, যেমন আপাদানা, ট্রেজারি, ও পাহাড়ে খোদিত রাজকীয় সমাধিগুলো— সবই আজও ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় পার্সেপোলিস গবেষণা প্রকল্প চলছে, যার মূল লক্ষ্য দূষণ প্রতিরোধ, ভাঙচুর রোধ এবং এই অমূল্য ঐতিহ্যকে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা।

পার্সেপোলিস শুধু ইরানের নয়, সমগ্র মানবজাতির এক অমূল্য ঐতিহ্য।  এটি তৈরি করেছিল স্থাপত্যের এক মহাকাব্য, যার পঙক্তিগুলো আজও অনবরত বলে চলেছে ক্ষমতা, ঐক্য আর অতুলনীয় শৈল্পিক সাফল্যের গাঁথা।#

পার্সটুডে/এমএআর/১৩