ইসলামি বিপ্লবের ৪০ বছর: মার্কিন শত্রুতা ও ইরানের প্রতিরোধ (পর্ব-৪)
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভ করে। এ বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার চেহারা পাল্টে দেয়। এ বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার হাত কেটে দেয় এবং মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎসস্থলে পরিণত হয়। এ পর্বে আমরা আমেরিকার বিরামহীন শত্রুতা এবং ইসলামি ইরানের প্রতিরোধের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করব।
"ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের আগে সাবেক স্বৈরশাসক রেজা শাহের আমলে ইরান ছিল আমেরিকার আজ্ঞাবহ একটি দেশ। কারণ এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করাই ছিল আমেরিকার উদ্দেশ্য এবং রেজা শাহ ছিল তার প্রধান সহযোগী। বিদেশি কোম্পানিগুলো অবাধে ইরানের তেল উত্তোলন করে নিয়ে যেত। এ ছাড়া, তেহরানে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস সমগ্র পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে গোয়েন্দাবৃত্তির আখড়া হিসেবে ব্যবহৃত হত। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বলেছিলেন, ইরানকে আমেরিকার জন্য নির্ভরযোগ্য একটি দ্বীপ হিসেবেই দেখা হত।"-এই কথাগুলো বলেছেন, আমেরিকার যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ভার্জিনিয়া ডিফেন্ডার সাময়িকীর সম্পাদক ফিল ভিলাইতু। তিনি এক সাক্ষাতকারে ইরানের ইসলামি বিপ্লব এবং ইরানি জনগণের বিরুদ্ধে মার্কিন শত্রুতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ কথা বলেছেন।

বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামি বিপ্লবের আগে ও পরে ইরান আমেরিকার পক্ষ থেকে নানা ধরণের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে।
গত প্রায় অর্ধ শতাব্দি ধরে আমেরিকা ইরানের সঙ্গে শত্রুতা করে আসলেও বরং তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো হুমকি ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় নিজের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা ইরানকে দুর্বল করার এবং দেশটির সার্বভৌমত্ব ও অগ্রগতির ধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের শুরুতেই আমেরিকা এ বিপ্লবকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত ১৫ জুলাই দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া সাক্ষাতকারে এ কথা স্বীকার করেছেন। ওই সাক্ষাতকারে ওবামা বলেন, "ইরানের ইতিহাসের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব ওই দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাতে আমরা চেষ্টা চালিয়েছি।" ওবামা আরো বলেন, "ইরাকের সাদ্দাম যখন ইরানের বিরুদ্ধে বেআইনি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে তখনই আমরা সাদ্দামকে সমর্থন দিয়েছি।"
খ্যাতনামা মার্কিন চিন্তাবিদ নওম চমস্কি ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার শত্রুতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, "মার্কিন কর্তাব্যক্তিরা ও তাদের নিয়িন্ত্রীত গণমাধ্যমগুলো সবসময়ই ইরানকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসেবে প্রচার চালিয়ে আসছে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে কঠোরতা দেখালেও এ কঠোরতা আরো আগে থেকেই চলে আসছে।" তিনি বলেন, "ইরানের অপরাধ হচ্ছে তারা ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে এমন এক স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছে যাকে আমেরিকা ১৯৫৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু ইরানের বিপ্লব এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনে মার্কিন বাসনাকে চীরতরে ধ্বংস করে দেয় এবং এটাই ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার শত্রুতার অন্যতম কারণ।" মার্কিন চিন্তাবিদ নওম চমস্কি আরো বলেছেন, "বিশ্বে যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে মাফিয়া চক্রের প্রভাবের বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়। বিশ্বে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই মাফিয়া চক্রের মাধ্যমে পরিচালিত বা সংঘটিত হয়। এই চক্রের শীর্ষে অবস্থানকারী আমেরিকা বিরোধী পক্ষকে কোনোভাবেই সহ্য করতে রাজি নয়।"
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত সরকার উৎখাতের পেছনে আমেরিকার কিছু উদ্দেশ্য ছিল। কেউ কেউ মনে করেন এসব উদ্দেশ্যের অন্যতম হচ্ছে ইরানে পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেশটির তেল ক্ষেত্রের একটি অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করা। আবার কারো মতে, সে সময়টি ছিল শীতল যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থা। সোভিয়েত ইউনিয়নের মোকাবেলায় এবং কমিউনিষ্ট সরকারের পতন ঠেকাতে ইরানে পছন্দের সরকার বসিয়েছিল আমেরিকা। শীতল যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই ভূ-কৌশলগত অবস্থান এবং তেলের খনির কারণে আমেরিকার কাছে ইরানের বিরাট গুরুত্ব ছিল। এ ছাড়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ইরানের ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছিল। এশিয়ায় কমিউনিজমের প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইজেন হাওয়ার ১৯৫৩ সালের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে বলেছেন, মার্কিন সরকার ইরানসহ এশিয়ার দেশগুলোতে কমিউনিজমের প্রভাব ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে এবং এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এ অবস্থায় ১৯৫১ সালের জুনে ক্ষমতার বাইরে থাকা ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের নেতা ইউনস্টোন চার্চিল ও অ্যান্থেনিও ইডেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, 'আমেরিকা ও ব্রিটেন সম্মিলিতভাবে যেন ইরানের জনপ্রিয় মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটায়।'
প্রস্তাবের অর্থ হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো। মার্কিন ইতিহাসবিদ ডেভিড পিটার মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য হস্তক্ষেপের পরিণতির ব্যাপারে লিখেছেন, "ইরানে হস্তক্ষেপের জন্য আমাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে।" ২০১৬ সালে আমেরিকায় নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের প্রতিনিধি বার্ণি সেন্ডার্স বিভিন্ন দেশে মার্কিন হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, "অপছন্দের সরকার পতনের জন্য অন্য দেশে আমেরিকার হস্তক্ষেপের ইতিহাস অনেক পুরানো।" এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৫৩ সালে মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটানোর কথা উল্লেখ করেন যিনি ছিলেন ইরানের জনগণের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আরো বলেন, "শুধু আমেরিকা ও ব্রিটেনের স্বার্থ রক্ষার জন্যই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। পরে স্বৈরাচারী শাহ ক্ষমতায় আসে এবং এরপর ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়। আর বিপ্লব পরবর্তী অবস্থার কথা আমরা সবাই জানি।" মার্কিন ডেমোক্রেট দলের প্রতিনিধি বার্ণি সেন্ডার্স আরো বলেছেন, " মোসাদ্দেককে উৎখাত করা ছিল একটি বিপর্যয়। আমি বলতে চাই আমেরিকার উচিত নয় কোনো সরকারকে এভাবে উৎখাত করা এবং এটা অনৈতিক। কারণ এর ফলে ওইসব এলাকায় অস্থিতিশীলতা ও বিপর্যয় নেমে এসেছে।"
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, "ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন শত্রুতার একটি কারণ হচ্ছে, ইরান আমেরিকার কাছে মাথা নত করেনি এবং বর্তমানে এ দু'দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আরো জটিল ও চরম আকার ধারণ করেছে।

ইরান আজ হাজার হাজার শহীদের রক্তের ওপর মর্যাদা ও শক্তিমত্বার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে এবং জনগণ ইসলামি বিপ্লবকে ধরে রেখেছে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমেরিকা যে বিপদ ও মুসিবত চাপিয়ে দিয়েছে তা অতিক্রম করে যাবে ইরানের জনগণ। এমনকি মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় অর্থনৈতিক ক্ষতি সত্বেও ইরানের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বজায় থাকবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানকে নতজানু করার চেষ্টা করলেও গত ৪০ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে আমেরিকা কোনো লক্ষ্যই অর্জন করতে পারেনি।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
- খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন