মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন হতো না: শওকাত হোসেন
ইসলামে বিশ্বাসী মুসলমানরা আজ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে কালই বিশ্ব পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশ আমেরিকা ও ইহুদিবাদের পুতুল হয়ে কাজ করছে।
মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন হতো না। সিরিয়া ও ইয়েমেনের আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। রেডিও তেহরানের সাথে এসব কথা বলেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও আজকের ভোলার সম্পাদক মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: ইরানের ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর মহান নেতা ইমাম খোমেনী (র) ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত সময়কে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ ঘোষণা করেছিলেন। সেই অনুযায়ী সারা বিশ্বে ঐক্য সপ্তাহ পালন করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- সমসাময়িক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ কতটা গুরুত্ব বহন করে?
মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন: একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনী(র)- ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর পরই বিশ্ব মুসলমানদের প্রতি বিশেষ করে যারা কালেমায় বিশ্বাসী তাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত সময়কে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ ঘোষণা করেছিলেন। এরমাধ্যমে তিনি বিশ্ব মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের একটি দ্বার উন্মোচন করেছিলেন।
আর সেই ‘ঐক্যসপ্তাহ’ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঐক্যসপ্তাহ ঘোষণার পর এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে অথচ দুর্ভাগ্যবশত এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ঐক্য সপ্তাহ ঘোষণার পর বিশ্ব মুসলমানদের যে কাজটি করার কথা ছিল তা আমরা করতে ব্যর্থ হয়েছি।
মুসলিম বিশ্বে আমরা দেখতে পাই নিজেদের মধ্যে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সাম্রাজ্যবাদীরা যে উদ্দেশ্যে মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল তাদের সেই উদ্দেশ্য এখন সফল হতে যাচ্ছে। ইয়েমেনের দিকে তাকালে সে বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। সিরিয়াতেও সেই একই চিত্র দেখতে পাই। আর এটাকে উসকে দেয়ার জন্য যতগুলো সেক্টরে কাজ করা দরকার তার সব কিছুই করছে মুসলমানরা। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। ইসলামে বিশ্বাসী মুসলমানরা আজ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে কালই বিশ্ব পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যাবে।
পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহ রাব্বুল নিজেই বলেছেন, তোমরা ঐক্যবদ্ধ আল্লাহর রজ্জুকে ধরো- সাবধান পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আল্লাহর এই একটি নির্দেশকে যদি মুসলিম বিশ্বের শাসকরা এক্সিকিউট করেন তাহলে বিশ্বে ইসলাম হবে সর্বশ্রেষ্ঠ।
ইয়েমেন, সিরিয়া থেকে শুরু করে মিয়ানমার পর্যন্ত মুসলমানদের যে দুর্গতি চলছে-যদি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য থাকত তাহলে এসব হতে পারত না। বিশ্বের কোনো অপশক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করার সাহস পেত না। কিন্তু দুভার্গজনকভাবে মুসলিম বিশ্বের শাসকরা সাম্রাজ্যবাদীদের পুতুল হয়ে কাজ করছে। এরফলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যুদ্ধ বিগ্রহের শিকার হয়ে আমরাই মরছি। আর ঐক্যবদ্ধ না থাকলে এ অবস্থা আগামীতেও চলতে থাকবে। ফলে আল্লাহর যে নির্দেশ –মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হলে পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদের কিছুই করতে পারবে না। ফলে ঐক্যই একমাত্র পথ মুসলমানদের বাঁচার। অন্যদিকে মুসলমানদের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
রেডিও তেহরান: আচ্ছা, ইমাম খোমেনী (র)-এর ঘোষণার পর অন্য মুসলিম দেশগুলোর কী দায়িত্ব ছিল এবং সেসব দেশ কী তা পালন করেছে বলে মনে করেন?
মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন: আমি মনে করি ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ নিয়ে ইমাম খোমেনী (র)’র ঘোষণা একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা। বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে অনৈক্যের একটা বিষয় ছিল সেটাকে দূর করার জন্য ইমাম খোমেনী (র) এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তখন মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের উচিত ছিল এই ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। নিজ নিজ দেশে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ দূর করা। কিন্তু তা করতে মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয়েছে। আর সেই ব্যর্থতার নির্মম ফল হিসেবে মুসলমানরা পর্যুদস্ত হচ্ছে।
রেডিও তেহরান: মুসলিম বিশ্বে যেসব রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে তা থেকে বেরিয়ে এসে শক্তিশালী ঐক্য করা কী খুব কঠিন কোনো কাজ? এ ক্ষেত্রে বাধাগুলো কী বলে আপনার মনে হয়?
মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন: মুসলিম বিশ্বে যেসব রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে তা থেকে বেরিয়ে এসে শক্তিশালী ঐক্য করা কী কঠিন কোনো কাজ বলে আমি মনে করি না। আবার আংশিক যে কঠিন সেকথাও সত্য। আংশিক কঠিন এই কারণে যে, দুভার্গ্যজনকভাবে মুসলিম দেশে নির্বাচনও যথাযথভাবে হয় না। বেশীরভাগ দেশেই ক্ষমতা দখল করে আছে। বেশীরভাগ মুসলিম দেশের সরকার প্রধানরা পশ্চিমা প্রভূদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের প্রভূরা হচ্ছেন ইহুদি–নাসরারা। ইসরাইল-আমেরিকা হচ্ছে তাদের প্রভূ। তাদের কৃপায় ক্ষমতায় তাই তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা উদগ্রীব থাকে। আর এ কারণে মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা সবকিছু বুঝেও ঐক্যের দিকে না গিয়ে বিভক্তির কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে শুধু ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে।
এর কারণ হিসেবে আরো যে বিষয়গুলো দেখতে পাই সেটি হচ্ছে, বেশিরভাগ মুসলিম দেশে আমরা দেখতে পাই রাজতন্ত্র। আর রাজতন্ত্র যেখানে আছে সেখানে সাধারণ মানুষকে তোয়াক্কা করা হয় না। সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ার দিকে তাদের কোনো দৃষ্টি থাকে না। তারা তাদের গদি টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত থাকে। রাজতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্র যেসব দেশে আছে তারা জনগণের যেকোনো স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত থাকে। এক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশিত ঐক্যের বিষয়টিকেও জলাঞ্জলি দিয়ে কেবলমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় বেশ কিছু মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। এসব রাষ্ট্রনায়করা সাম্রাজ্যবাদিদের হয়ে অনৈক্যকে আরো শক্তিশালী করছে।
এসবের পরও আমি এখনও মনে করি মুসলিম বিশ্বের জনগণ ও শাসকদের মধ্যে এই অনুভূতি আসা উচিত আমরা সবাই আল্লাহ রাসুলে এবং ইসলামে বিশ্বাসি। আর এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলমানদের জন্য কাজ করব-ইসলামের জন্য কাজ করব। এই অনুভূতি যদি আজ সৃষ্টি হয় তাহলে ইমাম খোমেনী(র)’র ঐক্য সপ্তাহ ঘোষণার যে আদর্শ তা বাস্তবায়িত হবে।
রেডিও তেহরান: ‘ইসলামী দেশসমূহে যেসব নাপাক লোকজন শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়; বরং তারা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল, যারা ইসলামী দেশসমূহকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়।’ মরহুম ইমাম খোমেনীর এ মন্তব্যে কতটা বাস্তবতা আছে?
মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন: মরহুম ইমাম খোমেনী (র)’র ওই বক্তব্যের বাস্তবতা আজও অবশ্যই আছে বরং তা একটুও কমেনি। যে প্রেক্ষাপটে ইমাম খোমেনী(র) বলেছিলেন যে, ‘ইসলামী দেশসমূহে যেসব নাপাক লোকজন শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়; বরং তারা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল, যারা ইসলামী দেশসমূহকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়।’ আজও সেই প্রেক্ষাপট সমানভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আজকের দিনেও শিয়া-সুন্নি যে বলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হচ্ছে এর পেছনে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ, ইহুদিবাদ ও আমেরিকা। তাদের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে যদি আমরা শিয়া-সুন্নি ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের রজ্জুকে শক্তভাবে ধরতে পারি তাহলে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত ঐক্যসপ্তার উদ্যোগও সফল হবে। বিশ্ব মুসলমানদের দুর্গতির দিন শেষ হবে।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৯