ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর ইরান সফর: আর্থ-রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব
(last modified Mon, 27 Jul 2020 12:07:08 GMT )
জুলাই ২৭, ২০২০ ১৮:০৭ Asia/Dhaka
  • ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে  ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত
    ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল কাজেমি সম্প্রতি ইরান সফর করে গেছেন। দায়িত্ব লাভের পর এটাই ছিল তার প্রথম বিদেশ সফর। ইরাকের অন্যান্য প্রধানমন্ত্রীর মতো মোস্তফা আল কাজেমিও ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ইরাকসহ পশ্চিম এশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের এ সাক্ষাত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সাক্ষাতের মাধ্যমে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা একদিকে ইরাকের ব্যাপারে ইরানের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন এবং অন্যদিকে এ সাক্ষাত ছিল আমেরিকার জন্য অনেক বড় ও কঠিন বার্তা।

ইরাকের ব্যাপারে ইসলামি ইরানের একটি নীতি হচ্ছে দেশটির নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও একটি শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জানানো। ইরাকের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া সাক্ষাতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, 'আমরা একটি স্বাধীন- সার্বভৌম ও মর্যাদাসম্পন্ন ইরাক দেখতে চাই।'

বাস্তবতা হচ্ছে, ইরান সরকার কাজের মাধ্যমে ইরাকের ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছে। ইরাক যখন উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস'র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল তখন ইরানও তাদেরকে সহযোগিতা করেছে। এ জন্য ইরাকের কর্মকর্তারা বহুবার ইরানের প্রশংসা করেছেন। ইরাকের নতুন প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল কাজেমিও তেহরানে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড.হাসান রুহানির সঙ্গে সাক্ষাতে এ ব্যাপারে বলেছেন, 'ইরান হচ্ছে এ অঞ্চলের প্রথম দেশ যে কিনা আইএস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরাকের পাশে ছিল এবং ইরাকিরা কখনো ইরানের এ অবদানের কথা ভুলবে না।'

ইরাকের সঙ্গে ইরানের রয়েছে দীর্ঘ এক হাজার ৫০০ বর্গ কিলোমিটার সীমান্ত। এ কারণে ইরান চায় ইরাকে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থা টিকে থাকুক। যদিও পাশ্চাত্য ও অনেক আরব দেশ ইরাকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায় না।

ইরাকে মার্কিন সেনা

ইরাকের ব্যাপারে ইরানের আরেকটি কৌশলগত নীতি হচ্ছে ওই দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বাইরের যে কোনো দেশের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করা।

এ ব্যাপারে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইরাকের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, আমরা আমেরিকার সঙ্গে ইরাকের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ করব না। কিন্তু আমেরিকা সাদ্দাম পরবর্তী সময়ের মতো ইরাকের  শাসন ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে যা গ্রহণযোগ্য নয়।

গত কয়েক বছরে বিশেষ করে গত অক্টোবরের শেষ সময়ে ইরাকে সরকার বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত মোস্তফা আল কাজেমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। কিন্তু তার দায়িত্ব লাভের পর দেশটির কোনো কোনো মহল তেহরান-বাগদাদ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিরোধিতা করছে। এমনকি তারা ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইরানের হস্তক্ষেপেরও অভিযোগ তুলছে। এ ব্যাপারে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ ধরণের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, বরং আমেরিকাই ইরাকে গোলযোগ বাধিয়ে দুর্বল সরকার গঠনের চেষ্টা করছে এমনকি তারা ইরাকি নয় এমন ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা দেয়ারও চেষ্টা করছে। 

ইরাকের শীর্ষ ধর্মীয় নেতাদের গঠনমূলক ভূমিকা এবং জনপ্রিয় স্বেচ্ছাসেবী মিলিশিয়া  বাহিনী হাশদ আশ শাবির প্রতি সমর্থন দেয়া ইরানের আরেকটি নীতি। কারণ ইরাকের স্বাধীনতা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় ধর্মীয় নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে অন্যদিকে হাশদ আশ শাবিও দেশটির সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় বিরাট অবদান রেখে চলেছে। বিদেশী মদদপুষ্ট দায়েশ তথা আইএস সন্ত্রাসীরা ইরাকের বহু এলাকা দখল করে নেয়ার পর দেশটির শীর্ষ শিয়া ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশে হাশদ আশ শাবি মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। বর্তমানে এ বাহিনী বিভিন্ন মহলের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ইরানে সর্বোচ্চ নেতা ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে বলেছেন, হাশদ আশ শাবি হচ্ছে ইরাকিদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় নেয়ামত এবং অবশ্যই এটিকে রক্ষা করা উচিত।

ইরাকের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া সাক্ষাতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার বক্তব্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তিনি আমেরিকাকেও কঠোর বার্তা দিয়েছেন। আর সে বার্তা হচ্ছে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি'র কুদস ফোর্সের প্রধান লে. জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ও ইরাকের হাশদ আশ শাবির কমান্ডার আবু মাহদি আল মোহান্দেসকে হত্যার অবশ্যই বদলা নেবে ইরান। ওই হত্যাকাণ্ডের পরপরই ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ছিল সামান্য চপেটাঘাত মাত্র। এরপর থেকে ইরাকে মার্কিন সেনারা সবসময়ই আতঙ্কের মধ্যে থাকে। 

যাইহোক, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আল কাজেমির ইরান সফরের পেছনে বেশি কিছু লক্ষ্য রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে মধ্যস্থতা করা।

এমনকি আমেরিকা ও ইরানের মধ্যেও মধ্যস্থতা করাও তার এ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে মনে করা হচ্ছে। সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের পতনের পর থেকে ইরাক ও ইরানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রয়েছে। বর্তমানে দুদেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১২শ’ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। কিন্তু পাশ্চাত্য এবং অনেক আরব দেশ ইরান ও ইরাকের এ সম্পর্কের  ঘোর বিরোধী। এ কারণে ইরাকের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোস্তফা আল কাজেমি দায়িত্ব লাভের পর কিছু আরব দেশ বিশেষ করে সৌদি গণমাধ্যমগুলো তেহরানের সঙ্গে বাগদাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো আরব গণমাধ্যম দাবি করেছে, ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে প্রতিনিধি দলটি ইরানে গেছেন তাদের অন্যতম উদ্দেশ ছিল তেহরানের সঙ্গে বেশ কিছু চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মোস্তফা আল কাজেমি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভের পর প্রথম বিদেশ সফরে ইরানে আসা থেকে বোঝা যায় তিনি তেহরানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে ভীষণভাবে আগ্রহী।  

কাজেমি তেহরান পৌঁছেই ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হন। এ সাক্ষাতে তিনি বলেছেন, আমি সব ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা বিস্তারে আগ্রহী। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতিতে ও বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় এ সহযোগিতার  গুরুত্ব বহুগুণে বেড়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ কারণে ইরাকের অর্থ মন্ত্রণালয়সহ জ্বালানি ও তেল মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তারাও প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে তেহরানে এসেছেন। এ থেকে বোঝা যায় মার্কিন চাপ ও ষড়যন্ত্র এবং কয়েকটি গণমাধ্যমের অপপ্রচার সত্বেও ইরাকের বর্তমান প্রশাসন তেল, গ্যাস, বিদ্যুতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেহরানের সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা বিস্তারে আগ্রহী। ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর এ সফরকালে দুদেশের কর্মকর্তারা বাণিজ্যের পরিমাণ দুই হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

অর্থনৈতিক বিষয় ছাড়াও সামরিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বিস্তারে আগ্রহ দেখিয়েছে দুই দেশ। এ কারণে ইরাকের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও এ বিষয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রী আল কাজেমির সঙ্গে তেহরানে এসেছেন। এ থেকে  ইরাক ও ইরানের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য কোনো কোনো গণমাধ্যমের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছে। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন