এভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিজের জন্য অস্ত্রে পরিণত করেছে যুক্তরাষ্ট্র
পার্সটুডে- বিশ্বের বেশিরভাগ ফাইবার অপটিক কেবলগুলো যা ডেটা এবং বিভিন্ন রকম বার্তা বহন করে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে যায়। যখন এই কেবলগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছায় তখন ওয়াশিংটন এই কেবলগুলোর ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ধরুন পেরুর একটি কোম্পানি মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানির সাথে ব্যবসা করতে চায়। নিঃসন্দেহে, কোম্পানিগুলোর জন্য একে অপরের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করা কঠিন কোনো কাজ নয়। সাধারণত অর্থ লেনদেন করা এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রচুর পরিমাণে তথ্য সরবরাহের কাজও সহজ।
কিন্তু এখানে একটি বিষয় ভাববার আছে। আর তা হলো, কোম্পানিগুলো জানুক বা না জানুক, তাদের ফিনানশিয়াল এবং নন ফিনানশিয়াল ডিল অবশ্যই পরোক্ষভাবে হবে। সম্ভবত এসব লেনদেনের সিংহভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বা বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অর্থনৈতিক লেনদেন সংক্রান্ত চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর, এই লেনদেনের ওপর কঠোর নজরদারি করার ক্ষমতা ওয়াশিংটনের রয়েছে এবং তারা চাইলে যখন তখন ওই লেনদেন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারে।
অন্য কথায় বলা যায়, মার্কিন সরকার তাদের নিয়ন্ত্রিত অর্থ লেনদেনের এই সুবিধা বন্ধ করে দিলে পেরু ও মালয়েশিয়ান কোম্পানিগুলো তাদের আর্থিক লেনদেন সম্পূর্ণ করতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে, এভাবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি থেকে পেরু এবং মালয়েশিয়াকে সরিয়ে দিয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে ওই দুই দেশের বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে পারে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে আমেরিকার এই শক্তি বা প্রভাবের কারণ স্পষ্ট। বিশ্বের বেশিরভাগ বাণিজ্য হয় ডলারের মাধ্যমে। ডলার হল কয়েকটি প্রভাবশালী মুদ্রার মধ্যে একটি যা বিশ্বের প্রায় সমস্ত বড় বড় ব্যাংকে আর্থিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং ডলার সর্বাধিক ব্যবহৃত মুদ্রাগুলোর মধ্যে একটি। ফলে অনেক কোম্পানিকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা করতে হলে অবশ্যই ডলার ব্যবহার করতে হবে।
সরাসরি মালয়েশিয়ান রিংগিটের বিনিময়ে পেরুভিয়ান সোল বিনিময় করা যায় এমন কোন ব্যবস্থা নেই, তাই স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় ব্যাঙ্কগুলো বিনিময়ের সুবিধা দেয়ার জন্য তারা সোলে মার্কিন ডলার কিনে, তারপর ডলারে রিংগিট কেনে। এই অর্থ বিনিময়ের কাজ করার জন্য, ব্যাঙ্কগুলোকে অবশ্যই আমেরিকান আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্ত থাকতে হবে এবং ওয়াশিংটনের বেধে দেয়া নির্ধারিত নিয়মগুলো অনুসরণ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন অবিসংবাদিত অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হলো তার আরেকটি কারণও রয়েছে যা অতটা স্পষ্ট নয়। বিশ্বের বেশিরভাগ ফাইবার অপটিক কেবলগুলো যা ডেটা এবং বিভিন্ন রকম বার্তা বহন করে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে যায়। যখন এই কেবলগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছায় তখন ওয়াশিংটন এই কেবলগুলোর ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি প্রতিটি ডেটা প্যাকেজের উপর রিপোর্ট তৈরি করতে পারে। সুতরাং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহজেই সমস্ত ব্যবসা এবং অন্য দেশের কার্যকলাপ ও গতিবিধির ওপর নজরদারি করতে পারে। এ কারণেই তারা তাদের স্বার্থ হুমকির মুখে দেখলে আগাম তথ্য জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী প্রতিপক্ষের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।
হেনরি ফারেল এবং আব্রাহাম নিউম্যানের লেখা 'আন্ডারগ্রাউন্ড এম্পায়ার: হাউ আমেরিকা উইপোনাইজড দ্য গ্লোবাল ইকোনমি' বইটি ওয়াশিংটনের নজরদারি এবং নিষেধাজ্ঞার ক্ষমতা সম্পর্কে লেখা হয়েছে। এই বইটিতে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অস্ত্রে পরিণত করেছে, কিভাবে এই অস্ত্র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে এবং অবিসংবাদিত অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হলো সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
কিভাবে 9/11এর ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার এই শক্তি ব্যবহার করতে বাধ্য করেছিল এবং চীন ও রাশিয়াকে চাপে রাখতে কিছু ক্ষমতা ব্যবহার করেছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন হেনরি ফারেল এবং আব্রাহাম নিউম্যান। বইটিতে তারা আরও ব্যাখ্যা করেছেন, অন্য দেশগুলো হয়তো ওয়াশিংটনের এই অর্থ ব্যবস্থাকে পছন্দ নাও করতে পারে, তবে কারো পক্ষে এটি থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন।
এছাড়াও, এই বইয়ের লেখকরা এটা দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কীভাবে নিরাপত্তার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে যেটার অপব্যবহার তারা প্রায়ই করে থাকে। ফারেল ও নিউম্যান আরো লিখেছেন "ওয়াশিংটন, আমেরিকাকে রক্ষা করার জন্য, ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কগুলোকে আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ারে পরিণত করেছে এবং মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের এই প্রচেষ্টা ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হতে পারে।"
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছে করলে চীনকে বিশ্ব অর্থনীতির বেশিরভাগ অংশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে পারে; কিন্তু এতে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। এছাড়াও, অন্য দেশ বা জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়িয়েও দিতেও ওয়াশিংটন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। অতএব, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের চিন্তা করা উচিত কিভাবে মার্কিন দৌরাত্ব বন্ধ করা যায় কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।