স্বাস্থ্যকথা
'কণ্ঠের বেশি ব্যবহারকারীদের পলিপ ও নডিউল হয়ে থাকে'
শ্রোতাবন্ধুরা! স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে স্বাগত জনাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করি আপনারা সবাই ভালো ও সুস্থ আছেন। গত দুই পর্বে নাক কান গলার নানারকম সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুনেছেন। আজও একই বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলব। আর আমাদের সাথে অতিথি হিসেবে আছেন ই এন টি স্পেশালিস্ট ডা, এম মইনুল হাফিজ।
জনাব, ডা. এম. মইনুল হাফিজ রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
ডা. এম মইনুল হাফিজ: ধন্যবাদ আপনাকে।
রেডিও তেহরান: গত পর্বের আলোচনায় ডা. এম মইনুল হাফিজ আপনি গলায় মুখে ক্যান্সারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তো এ ধরনের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী আপনাদের কাছে এলো তো পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা কিভাবে হবে..
ডা. এম. মইনুল হাফিজ: দেখুন, ক্যান্সার চিরকালই আতঙ্কের। গলায় অথবা মুখ, টনসিল, লালা গ্রন্থি, সাইনাস, নাক এবং ঘাড়ের লিম্ফ নোডে প্রথম ধাপে ক্যান্সার যদি ধরা পড়ে তা থেকে মুক্তির পথ মিলতে পারে। তবে দেরি হয়ে গেলে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
আমেরিকার ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্রের মতে, “এই রোগটি সাধারণত ল্যারিনক্স (ভয়েস বক্স) বা ফ্যারিনক্স (গলা) কে বিশেষভাবে আক্রমণ করে। সাধারণত ল্যারিনক্স, এসোফ্যাগাস, ফুসফুস বা গলায় ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্যান্সারের ঝুঁকি। চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরে দেখা যায়, কিছু রোগের ক্ষেত্রে ফুসফুস, মুখ, গলার পার্শ্ববর্তী অংশে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে।
গলায় ক্যান্সারের সংক্রমণ নির্দিষ্ট অবস্থানের উপর নির্ভর করে। রোগের লক্ষণ কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে আসে না। যার ফলে সবসময় শনাক্ত করাও সম্ভব হয় না। কীভাবে বোঝা যেতে পারে ক্যান্সার আক্রমণ করেছে?
গলায় আলসার বা গলায় ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে, প্রথমত, ক্ষতিকারক খাবার খাওয়ার কারণে হতে পারে। ধূমপান সর্বদা গলার ক্যান্সারের শীর্ষ কারণ। যাঁরা তামাক, পান মসলা অথবা মদ ও তামাক একইসঙ্গে সেবন করেন, তাঁদের গলায় ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি একথা আগেই বলেছি।
মুখের ভিতরে সাদা দাগ হওয়া, জিহ্বার আস্তরণে জ্বালা বা অভ্যন্তরীণ গালের জ্বালা ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে একটি। জিহ্বায় ছোট ফুসকুড়ি হওয়াও অন্য উপসর্গ।
আরো একটি উপসর্গ হলো, কন্ঠস্বরে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেবে, অর্থাৎ গলা ভেঙে থাকবে বা কথা বলতে অসুবিধা হবে। যদি তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই সমস্যা থাকে, তবে এটি ল্যারেনজিয়াল ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
যদি গলায় বা মুখে ক্যান্সার হয় তাহলে আমরা অপারোশন করে থাকি। এরপর রেডিও থেরাপি, কেমোথেরাপি আছে। শুরুতে আমরা ডায়াগনোসিস করার জন্য নির্দিষ্ট স্থান থেকে মাংস কেটে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। বায়োপসি করা হয়। বায়োসপি (Biopsy) হচ্ছে শরীরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা সন্দেহজনক টিস্যু মূল্যায়ন করার জন্য একটি ডায়গনিস্টিক পদ্ধতি । দুইভাবে এই বায়োপসি করা হয়। সূচ ফুটিয়ে মাংসের কিছুটা অংশ নিয়েও বায়োপসি করা যায়। এছাড়া সংক্রামিত অংশের মাংস কেটেও বায়োপসি করা হয়। ভোকাল কর্ডের পাসে যেটাকে আমরা স্বরতন্ত্র বলি সেখানে বা লেরিন্সেও এই ক্যান্সার হতে পারে এবং সেটা একাধিক কারণে হতে পারে।
রেডিও তেহরান: ক্যান্সারের পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং চিকিৎসার বিষয় নিয়ে আপনি মোটামুটি একটা ধারনা দিলেন তো ক্যান্সার ছাড়াও গলায় আরও বিশেষ কিছু রোগ হয়। তো সেসব রোগ নিয়ে কি কিছু বলবেন?
ডা. এম. মইনুল হাফিজ: দেখুন, গলায় ক্যান্সার ছাড়াও আরও বেশ কিছু রোগ হতে পারে। কমন কিছু রোগের মধ্যে ভোকাল কর্ডের কিছু সমস্যা হতে পারে। ধরুন গলা ভেঙে গেছে এবং সেটা দুই মাসের ওপর হয়ে গেছে কিন্তু ভালো হচ্ছে না। এটা কিন্তু সন্দেহজনক ব্যাপার। এছাড়া ভোকাল কর্ডে পলিপ হয়ে থাকে। যারা বেশি চেঁচামেচি করেন বা উচ্চ গলায় কথা বলেন তাদের স্বরযন্ত্রের ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। একে আমরা বলি ভোকাল কর্ড নডিউল। যদি গলায় বেশি মাত্রায় প্রদাহ হয় তাহলে অনেক সময় স্বরযন্ত্রের ত্বকের আবরণী মিউকোসা ফুলে যেতে পারে। একে আমরা ভোকাল কর্ড পলিপ বলি। এই সমস্যায় ভোকাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সার্জারি করে পলিপ সরিয়ে ফেলতে হয়।
এ প্রসঙ্গে ভোকাল কর্ড(Vocal C o rd) কি সে সম্পর্কে একটু তথ্য দিয়ে রাখছি। স্বরযন্ত্রের দুই দিকে দুটি ভোকাল কর্ড থাকে যা কথা বলার সময় ভাইব্রেট করতে থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে প্রতি সেকেন্ডে ১৫০-২০০ বার এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রতি সেকেন্ডে ২০০-২৫০ বার ভোকাল কর্ড ভাইব্রেট করে। এটি কিছু মাংসপেশী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
নাক কান গলার কিছু সমস্যা ও তার প্রতিকার নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এম মইনুল হাফিজের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরিই। আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: ভোকাল কর্ডের কিছু রোগ, পলিপ কিংবা নডিউলের কথা শুনি- তো নডিউল সাধারণত কাদের হয়..
ডা. এম. মইনুল হাফিজ: জ্বি ধন্যবাদ আপনাকে চমৎকার একটি প্রশ্নের জন্য। পলিপ কিংবা নডিউল সাধারণ তাদের হয়ে থাকো যারা উচ্চস্বরে কথা বলেন, চেঁচামেচি করেন। যেমন ধরুন- শিক্ষক, অভিনেতা, হকার, আইনজীবী, সিংগার-তাদের কিন্তু এগুলো বেশি হয়। গলার রোগের ক্ষেত্রে এ দুটো বিষয় নিয়ে বহু রোগী আমাদের কাছে আসে। সাধারণত বড়দের ক্ষেত্রে এ সমস্যাগুলো বেশি হয়।
রেডিও তেহরান: বড়দের ক্ষেত্রে কি টনসিলে ক্যান্সার হতে পারে?
ডা. এম. মইনুল হাফিজ: জ্বি, বড়দের টনসিলে ক্যান্সার হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা বায়োপসি করি এবং যদি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে যেতে দেখি তকন টনসিল ফেলে দেই। যেখানে সার্জারির অপশন আছে সেখানে আমরা সার্জারি করে থাকি। আর যেখানে সার্জারির অপশন না থাকে তখন আমরা রেডিও থেরাপি কিংবা কেমোথেরাপি দিয়ে থাকি। কখনও কখনও সার্জিারি করার পর আমরা থেরাপিগুলো অ্যাডভাইস করে থাকি।
রেডিও তেহরান: ক্যান্সার হলে অপারেশন করে টনসিল ফেলে দেয়া কিংবা রেডিওথেরাপি দেয়ার কথা বললেন তো এতে ঝুঁকি কতটা?
ডা. এম. মইনুল হাফিজ: দেখুন,ক্যান্সার হলে সার্জারি করে টনসিল ফেলে দেয়াসহ এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা ডাক্তারি পরিভাষায় ঝুঁকি বলব না- আমরা বলব কমপ্লিকেশন আছে। এটি কেবলমাত্র নাক কান গলার না যেকোনো সার্জারির ক্ষেত্রে কমপ্লিকেশন যেটাকে আপনি ঝুঁকি বললেন সেটি থাকে। যেমন ধরুন অ্যানেস্থেসিয়ার সময় একটা ঝুঁকি থাকে। কখনও কখনও বেশি মাত্রায় ব্লিডিং হতে পারে,ইনফেকশন হতে পারে।
রেডিও তেহরান: ডা. এম মাইনুল হাফিজ, গলার ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসার খরচ সম্পর্কে যদি আপনি একটা ধারনা দেন। কারণ বাংলাদেশ ভারতসহ এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে চিকিৎসার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তো সেদিকটা বিবেচনায় নিয়ে যদি আপনি চিকিৎসা ব্যয়টা কেমন হবে সেটি যদি একটু বলেন।
ডা. এম. মইনুল হাফিজ: দেখুন, এই চিকিৎসার ব্যয় আসলে নির্ভর করে আপনার ফ্যাসিলিটিজের ওপর। ধরুন বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির হসপিটালগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ স্পেশালইজড হসপিটাল। গঠনগতভাবে খুবই ব্যয়বহুল একটি হাসপাতাল। ওখানে ওটিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। সেখানে গেলে ব্যয়ও বেশি হবে। আবার এটি যদি ছোট্ট একটি ক্লিনিকে করা হয় তাহলে সেখানে খরচ অনেক কম পড়বে। আর বড় বড় বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা হাসপাতালে খরচ বেশি পড়ে। সার্জেন্ট যারা সিনিয়র তাদেরও খরচ একটু বেশি দিতে হয়। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে আবার খবর কম। আমি বলব আমাদের দেশে নাক কান গলার চিকিৎসার খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
দেশের ৩০ শতাংশ লোক নাক, কান, গলার কোনো না কোনো রোগে ভুগছেন। আর আমি ধরুন ৩৫ বছর ধরে সার্জারি করে আসছি। আমার কাছে মনে হয় এখন মানুষ নাক কান গলার চিকিৎসা করাচ্ছেন। খরচও তাঁদের আয়ত্বের মধ্যে আছে।
ডা. এম মইনুল হাফিজ-নাক কান গলার বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও তার চিকিৎসা সম্পর্কে রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বিশিষ্ট এই চিকিৎসক গলার রোগের ক্ষেত্রে কিছু জরুরি কথা বললেন, কারও গলা ভেঙে গেছে এবং দুই মাসের বেশি হয়ে গেছে কিন্তু ঠিক হচ্ছে না-একই সাথে তিনি ধূমপান করেন-এটি কিন্তু ভয়ের কারণ, আবার যারা কণ্ঠের কাজ করেন-শিক্ষক, আবৃত্তি শিল্পী, হকার, আইনজীবী, যারা গান করেন- তাঁদের কিন্তু গলার সমস্যা হতে পারে। ফলে গলার কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই ই এন টি ডাক্তারের কাছে যাবেন এবং দ্রুত চিকিৎসার উদ্যোগ নেবেন।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৩০