নভেম্বর ০৫, ২০২২ ১৬:৫৯ Asia/Dhaka

ইরাকের আগ্রাসী সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ হাসান বাকেরি সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে ইরানি যোদ্ধাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিজয় উপহার দিয়েছিলেন। তিনি ইসলামি চিন্তাধারার আলোকে ‘আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান’কে যেকোনো যুদ্ধ জয়ের প্রধান হাতিয়ার মনে করতেন। তিনি নিজে মহান সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ তায়ালার ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীল হতে পেরেছিলেন।

হাসান বাকেরি মনে করতেন, যুদ্ধে সব বাহিনীর হাতেই সমরাস্ত্র থাকে কিন্তু বিজয় তাদেরই হয় যারা আল্লাহর তায়ালার পূর্ণ মদদ লাভ করে। এ কারণে তিনি আমেরিকাসহ সব পরাশক্তির ওপর নির্ভরশীলতাকে সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে করতেন যদিও শাহ সরকারের আমলে আমেরিকায় প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ইরানি সেনা কমান্ডারদের মতামত ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। এসব কমান্ডার বলতেন, আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া না গেলে যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়।

শাহ সরকারের আমলে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও বিশ্বাসের পরিবর্তে এসব উদ্ভট চিন্তাধারা সেনা কমান্ডারদের মস্তিষ্কে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের পর সে চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন আসে। এখন কমান্ডাররা শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করার সময় প্রথমেই আল্লাহর ওপর নির্ভর করেন এবং শাহাদাতের তামান্না অন্তরে পোষণ করেন। তারা এখন জানেন, যুদ্ধে জিতলে যেমন বাহ্যিক বিজয় থাকবে তেমনি শহীদ হয়ে গেলেও আল্লাহ তায়ালার কাছে অনেক বড় মর্যাদা লাভ করা সম্ভব হবে। শহীদ হাসান বাকেরি তার সংক্ষিপ্ত জীবনে এই কৌশল অবলম্বন করে অনেকগুলো অভিযানের পরিকল্পনা করেন এবং তার বেশিরভাগ পরিকল্পনাই সফল হয়। আর এই সফলতার কারণটিও ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার।

শত্রু সেনারা সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে এবং পরিপূর্ণভাবে ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রণকৌশল প্রণয়ন করত। শহীদ হাসান বাকেরির সহযোদ্ধা জেনারেল ফাতহুল্লাহ জাফরি এ সম্পর্কে বলেন, “ইরাকের বন্দি সেনা কমান্ডাররা বলত তাদের দৃষ্টিতে ইরানি শিবিরে এমন কিছু বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে যা তাদের কাছে ছিল অজানা। তাদের সব অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হতো বাগদাদের আল-বাকের সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়কে। অথচ ইরানের অভিযানগুলোর পরিকল্পনাকারী ছিলেন শহীদ হাসান বাকেরির মতো তরুণ সেনা কমান্ডারগণ। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর অভিজ্ঞ কমান্ডাররা স্বীকার করত যে, ইরানের অভিযানগুলোর সঙ্গে বিশ্বের কোনো সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের মিল নেই। ইরানিরা যে পদ্ধতিতে হামলা করে তা সম্পূর্ণ নতুন একটি চিন্তাধারা থেকে উৎসারিত।”

আল্লাহর প্রতি ঈমান ও নির্ভরশীলতা এমন একটি শক্তি যার সামনে বিশ্বের কোনো শক্তি দাঁড়াতে পারে না। এই নির্ভরশীলতা মানুষকে জীবনের কঠিন মুহূর্তেগুলোতে টিকে থাকার শক্তি যোগায়। যুদ্ধ যে মানবজীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই এই পরীক্ষায় শত্রুসেনাদের আগ্রাসন প্রতিহত করে তাদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে হলে প্রচণ্ড মানসিক শক্তির প্রয়োজন। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধারা সেই মানসিক শক্তি অর্জন করতে পেরেছিলেন। আর এ কারণেই ইরাকি বাহিনীর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও বড় বড় সামরিক বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত বড় বড় জেনারেল ইরানি বাহিনীর সামনে দাঁড়াতে পারছিল না। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে এটি প্রমাণিত সত্যে পরিণত হয়েছিল যে, আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বাহ্যিক প্রবল শক্তিমত্তা ইরানের ঈমানদার যোদ্ধাদের মনে বিন্দুমাত্র ভীতি সৃষ্টি করতে পারেনি।

হাসান বাকেরি এ সম্পর্কে বলেন, শত্রুদেরকে যে বিষয়টি দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল তা হলো আমরা কখনও হতাশ হইনি এবং আমাদেরকে কখনও অচলাবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। শহীদ বাকেরির দৃষ্টিতে যুদ্ধে জয়-পরাজয় থাকবেই কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা থাকলে একটি বাহিনী কখনও সম্পূর্ণ অচলাবস্থার সম্মুখীন হবে না। হাসান বাকেরি আরেকটি বিষয়ের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আর তা হলো আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার অপব্যাখ্যা যেন করা না হয়। ফাতহুল মোবিন অভিযানের পর বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের পরিকল্পনা করার সময় ইরানের সাবেক সেনাপ্রধান শহীদ সাইয়্যাদ শিরাজি পদস্থ কমান্ডারদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছিলেন।

তিনি যখন ফাতহুল মোবিন অভিযানের ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করার উপায় বর্ণনা করছিলেন তখন কয়েকজন কমান্ডার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ছোটখাট বিষয় নিয়ে এত বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই।আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা এ বিষয়গুলোর সমাধান করে ফেলব। এ সময় এসব কমান্ডারের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে শহীদ হাসান বাকেরি বলে ওঠেন: “আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করব ঠিকই কিন্তু একথাও মনে রাখতে হবে আল্লাহ তায়ালা নির্বোধ লোকদের হেদায়েত দান করেন না।”

আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতেই বুঝে গিয়েছিল যে, কয়েকদিনের মধ্যে তেহরান দখলের যে কল্পনা তারা করেছিল তা সুদূর পরাহত। সীমান্তবর্তী খোররামশাহরের অলিগলিতে যখন হাতাহাতি যুদ্ধ হচ্ছিল তখনই ইরানি যোদ্ধারা আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ নির্ভরতার সুফল পাচ্ছিলেন। যুদ্ধ যতই সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ততই ঈমানি শক্তি যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করছিল। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীও এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, সেরা সামরিক শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ঈমানি শক্তির দিক দিয়ে তাদের ঘাটতি রয়েছে।

ইরানের হাতে বন্দি একজন ইরাকি কমান্ডার এ সম্পর্কে বলেন: “ইরানের আবাদান শহর দখল করার পর আমরা সেখানে শক্ত দুর্গ গড়ে তুলেছিলাম। কিন্তু ইরানি যোদ্ধারা ওই শহর পুনরুদ্ধার করার পর আমাদের কমান্ডাররা একথা উপলব্ধি করেন যে, আমাদের পক্ষে আর ইরানের ভূমি দখল করে রাখা সম্ভব নয়। আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই আমাদের মধ্যে ঈমানি চেতনা দুর্বল। আমরা বৃহৎ শক্তিগুলোর পাশাপাশি সৌদি আরবসহ অন্যান্য আঞ্চলিক দেশের সহযোগিতায় আমাদের সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সমরাস্ত্রসহ অন্যান্য পার্থিব সাহায্য নিয়েও সে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয়নি।”#

পার্সটুডে/এমএমআই/৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ