ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৩ ২৩:৫৫ Asia/Dhaka

নারী সম্পর্কে যুগে যুগে নানা ধরনের চরমপন্থী বা প্রান্তিক ধারণা দেখা গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীকে খোদা বা প্রভুর সমতুল্য ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদেরকে পশুর সমতুল্য বলে ধরে নিয়েছে প্রাচীন মানব সমাজ।

আসলে তাদেরকে খুব কমই যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে গত কয়েকটি পর্বে প্রাচীন গ্রিস ও রোমে নারীদের অবস্থার কিছু দিক আমরা তুলে ধরেছি। আজ আমরা ইসলাম পূর্ব যুগের আরব সমাজের নারীদের অমানবিক অবস্থার বিষয়ে আলোকপাত করব। সে যুগের আরব নারীদের অবস্থা ছিল এত অমানবিক যে আরবরা নারী ও কন্যাদেরকে পশুর সঙ্গে বিনিময় করত এবং কেনা-বেচা করত; এত তাদের কোনো লজ্জা হত না। আরব নারীদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত কোনো অধিকার ছিল না। সে যুগের আরব সমাজ ছিল পুরুষের একক কর্তৃত্বাধীন। তারা সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করত এবং এমনকি সন্তানদের জীবিত রাখা ও না রাখা ছিল তাদের ইচ্ছাধীন বিষয়! 

আরব উপদ্বীপের লোকজন বেদুইনদের মত তাবুতে বসবাস করত। উষ্ণ ও শুকনো মরুময় এ অঞ্চলে পানি সহজলভ্য ছিল না। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের অনেকেই লুটপাট করে জীবন চালাত। তারা নানা ধরনের ভুল, অর্থহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণায় বিশ্বাস করত। অত্যন্ত গোঁড়া প্রকৃতির এই আরবরা নারীকে কেবল সন্তান জন্ম দেয়ার মাধ্যম, দাসী ও যৌন সেবিকা বলে মনে করত।  বাবারা নিজ কন্যাকে ও স্বামীরা নিজ নিজ স্ত্রীদেরকে দুর্বল ও মূল্যহীন অস্তিত্ব বলে ভাবত। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই আরব মায়েদের কোনো অধিকার ছিল না।

আরবদের মধ্যে একটি সংস্কার ছিল এমন যে তারা সফরে যাওয়ার সময় গাছের কোনো ডালে বা কাণ্ডে একটি রশি বেঁধে রাখত। ফেরার পর তারা যদি এ রশি দেখতে পেত তাহলে তারা ভাবত যে তাদের স্ত্রীরা এ সময়ে চারিত্রিক দিক থেকে পবিত্রই থেকেছেন। আর কোনো কারণে ওই রশি যদি নষ্ট হয়ে যেত তাহলে তারা স্ত্রীকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে তার ওপর যে কোনো ধরনের জুলুম চালাত। 

জাহিলি যুগের আরবরা কন্যা সন্তান জন্ম নেয়াকে অশুভ বলে ভাবত। তাই কোনো নারী কন্যা সন্তান জন্ম দিলে তা গোপন রাখত এবং নিজের বান্ধবী ও পরিচিত কাউকেই এ সংবাদ দিত না। স্বামী যদি তার কন্যা সন্তানের জন্ম নেয়ার খবর পেত তাহলে লজ্জায় নিজেকে গোপন করে রাখত কিংবা অত্যন্ত অনিচ্ছায় ও কোনো যত্ন নেয়া ছাড়াই ওই কন্যা সন্তানকে লালন করত। কন্যা সন্তান কিছুটা বড় হলে তাকে খুব রুক্ষ একটি পোশাক পরিয়ে পশু চরাতে পাঠানো হত। 

কন্যা সন্তানের জন্ম নেয়াকে অনেক আরব এতটা অশুভ ভাবত যে তারা ওই নবজাতক কন্যাকে জীবন্ত কবর দিতে প্রস্তুত থাকত। কোনোভাবে কন্যা সন্তানের জনক হওয়ার খবর পেলে অশুভ অবস্থা হতে মুক্তি পাওয়ার আশায় ও লোক-নিন্দা এড়াতে তারা কন্যাকে জীবন্ত কবর দিত। পবিত্র কুরআনের সুরা নাহল্-এ এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন,

'যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তারা মুখ কাল হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে, না- তাকে মাটির নীচে পুতে ফেলবে! শুনে রাখ, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট।–

মসজিদে মুসলিম নারী

 

কন্যা সন্তানকে সুশিক্ষিত করে একজন যুবকের কাছে বিয়ে দেয়ার ধারণা জাহেলি জামানার আরবদের কাছে ছিল খুবই অসম্মানজনক বিষয়!  সে যুগে আরব গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘাত ও যুদ্ধ লেগেই থাকত। তাই তারা যুদ্ধের জন্য সাহসী পুত্র সন্তানের জন্ম কামনা করত। অন্যদিকে যুদ্ধের সময় কন্যা সন্তান বা নারীরা যুদ্ধ-বন্দী হত। আর এ বিষয়টিও ছিল পুরুষদের জন্য বড় ধরনের কলঙ্ক! তাই এইসব লজ্জার সম্ভাব্য শিকার হওয়ার আগেই তারা কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত! 

জাহিলি যুগের আরব রীতি অনুযায়ী নারী ও শিশুরা সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারত না! কোনো স্ত্রী বিধবা হলে তার পুত্র সন্তান, শশুর বা দেবর তাকে বিক্রি করত অথবা তাকে কারো কাছে অর্পণ করে বিনিময়ে কোনো পণ্য সংগ্রহ করত!  দেবর বা শশুর এই নারীকে কখনও বিয়ে করত বিনা মোহরানায় অথবা তাকে অন্য কারো কাছে বিয়ে দিয়ে মোহরানার অর্থ নিজেরা নিত। কখনওবা ওই বিধবাকে আর বিয়েই করতে দিত না! 

জাহেলি যুগে জীবনসঙ্গী নির্বাচনে নারীর পছন্দ বা অধিকার ছিল খুবই সীমিত। অন্যদিকে এ বিষয়ে পুরুষের ছিল পরিপূর্ণ অধিকার। মেয়েদের জন্য সর্বপ্রথম যে প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিতে হত তা হল চাচাতো ভাইকে বিয়ে করা। চাচাতো ভাই এ বিষয়ে আগ্রহী না হলে অন্যরা এ বিষয়ে অগ্রণী হতে পারত। সময়ের পরিক্রমায় পারিবারিক বিয়ের স্থান দখল করে গোত্রীয় বিয়ে এবং এ ধরনের বিয়ে গোত্রের মধ্যে ব্যক্তির সম্মান বাড়িয়ে দিত।

জাহেলি যুগের আরব পুরুষরা যত খুশি তত সংখ্যক নারীকে বিয়ে করতে পারত। স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠারও কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। পুরুষের কাছে যে স্ত্রী ছিল সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় সেই স্ত্রী অন্য স্ত্রীদের তুলনায় ভালো অবস্থায় থাকত। ইন্দ্রিয় ভোগ-বিলাসে ডুবে থাকা ছিল সে যুগের আরব পুরুষদের অনৈতিক অবস্থার সাধারণ চিত্র। অনেক পুরুষ তার দাসীদের দেহ-ব্যবসায় নিয়োজিত করে অর্থ উপার্জন করত। 

ইসলামপূর্ব যুগে তথা অজ্ঞতার যুগে আরব সমাজে তালাক ছিল কেবলই পুরুষের নিয়ন্ত্রিত বিষয়। রাগের মাথায় বা অজ্ঞতাপ্রসূত কিংবা স্ত্রীর গোত্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে তারা তালাক দিত। তালাকের পর অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করার অধিকার নারীর ছিল না! তালাক দিলেও সাবেক স্ত্রীকে অন্য কোনো পুরুষের স্ত্রী হতে দেখাকে তারা অপমানজনক বলে মনে করত! অবশ্য কখনও কখনও অর্থের বিনিময়ে তারা এ বিষয়ে সম্মতি দিত! এভাবে তালাকের বিষয়টিও ছিল আরব পুরুষদের হাতে শোষণ বা সুবিধা হাসিলের হাতিয়ার! #

পার্সটুডে/এমএএইচ/৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ