এপ্রিল ০৮, ২০২৩ ১১:৫৪ Asia/Dhaka

পবিত্র রমজান আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাস। মহান আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন পাপ-প্রবৃত্তি দমন করার নানা মাধ্যম। আক্বল্‌ বা বিবেক-বুদ্ধি, লজ্জাশীলতা, তাকওয়া বা খোদা-সচেতনতা এইসব মাধ্যমের অন্যতম।

রমজান মাসে আমরা অনেক বৈধ কাজই বর্জন করে থাকি। তাই অবৈধ কাজ বা পাপ বর্জন করা মানুষের পক্ষে কঠিন নয়। অনেক আধ্যাত্মিক সাধক মনে করেন যারা আধ্যাত্মিক উন্নয়ন চান তাদেরকে অনেক বৈধ কাজও বছরের বেশিরভাগ সময়ই বর্জন করতে হবে। যেমন, প্রায়ই অতি সুস্বাদু খাবার না খাওয়া বা সুস্বাদু শীতল ও উষ্ণ পানীয় পান না করা। তবে হারাম নয় বলে এসব মাঝে মধ্যে অল্প মাত্রায় খাওয়া যেতে পারে।  প্রায়ই সুস্বাদু তরি-তরকারি বা মাছ-মাংস খাওয়ার পরিবর্তে বেশিরভাগ সময়ই অতি সাধারণ খাবার সাদামাটাভাবে রান্না করে খাওয়া উচিত বলে মনে করেন আধ্যাত্মিক উন্নয়ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা। গরমকালে অতিরিক্ত মাত্রায় ঠাণ্ডা পানীয় ও শীতকালেও বেশি মাত্রায় উষ্ণ পানীয় পান না করা সংযম সাধনার জন্য জরুরি।

কিছু কিছু কাজ হারাম বা অবৈধ না হলেও অপছন্দনীয়। আত্মিক সংশোধনের জন্য সেসবও বর্জন করতে হবে। অতি-ভোজন বা ভূরিভোজন হারাম না হলেও অপছন্দনীয়। এ বিষয়টি স্বাস্থ্যের জন্যও যেমন অকল্যাণকর তেমনি তা আত্মাকেও দুর্বল করে দেয়। তদ্রূপ অতিরিক্ত ঘুম বা বিশ্রাম এবং অতি-কথন এসবও আত্মা ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

পাপের পরিবেশ প্রশস্ত হয় এমন কাজ বা অবস্থা থেকে দূরে থাকাটাও পাপ বর্জনের এক উত্তম উপায়। যেমন, বেশি কথা বলা পাপের পথ প্রশস্ত করার সহায়ক হয় অনেকের জন্য। কারো কারো ক্ষেত্রে বেশি অর্থ ও সম্পদ আলস্য এবং পাপ বয়ে আনে।

অনেক ব্যক্তি এই বলে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন যে, আল্লাহর অশেষ শোকর যে মানুষের ওপর জুলুম করার বা মানুষকে বিরক্ত করার শক্তিও আমার নেই! তাই যা কিছু আমাদের নেই তা নিয়ে যেন আমরা আফসোস না করি।

পাপ থেকে দূরে থাকার সর্বোত্তম পথ হল খোদা-সচেতনতা বা তাকওয়া অর্জন। এ ছাড়াও মহান আল্লাহ সম্পর্কে সুদৃষ্টি বা সুধারণা থাকলে আল্লাহ তাকে পাপ থেকে দূরে রাখেন। অন্যদের ও নিজের আশপাশের লোকদের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার মাধ্যমেও আমরা পাপ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে সক্ষম হব। বিপদে-আপদে ধৈর্যধারণকারী ব্যক্তিও পাপ-বর্জনের প্রেরণা ও সৌভাগ্য অর্জন করেন। মহান আল্লাহর অত্যধিক জিকির বা স্মরণ, আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন এবং রাত জেগে ইস্তিগফার বা তওবা করাও পাপ-বর্জনের অন্যতম বড় মাধ্যম। পাপ বর্জনের জন্য মহান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়াও করতে হবে।

নবী-রাসুল এবং মহাপুরুষদের জীবনী পাঠও মানুষকে পাপ থেকে দূরে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) হচ্ছেন এমনই এক মহাপুরুষ এবং পরিপূর্ণ আদর্শ মানব।  ৪০ হিজরির ১৮ ই রমজানের দিন শেষে ১৯ রমজানের ভোর বেলায় ইবনে মোলজেম নামের এক ধর্মান্ধ খারেজি ফজরের নামাজে সিজদারত আমীরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আঃ)'র মাথায় বিষ-মাখানো তরবারি দিয়ে আঘাত হানায় দুই দিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন। এ ঘটনা ঘটেছিল কুফার গ্র্যান্ড মসজিদে। অনেকেই মনে করেন ১৮ রমজানের দিবাগত রাত তথা ১৯ রমজানের রাত শবে কদর তথা মহিমান্বিত রাত। এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।

শাবান মাসের শেষ শুক্রবারে রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশ্বনবী (সা.) ভাষণের শেষ পর্যায়ে কাঁদতে থাকেন। তা দেখে হযরত আলী (আ.) এর কারণ জানতে চান। জবাবে মহানবী বহু বছর পর রমজান মাসে আলী (আ.)'র মর্মান্তিক শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন,"হে আলী! এই মাসে তোমার ওপর যা নেমে আসবে সে জন্য আমি কাঁদছি। আমি নিজেকে কল্পনা করছি তোমার স্থানে যখন তুমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছ এবং সামুদ জাতির কাছে পাঠানো খোদায়ী উটের পা কর্তনকারী লোকটির মতই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিটি তোমার মাথার ওপর আঘাত হানবে এবং তোমার দাড়ি তাতে (রক্তে) রঞ্জিত হবে।" 

নিজের শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা শুনে সব কিছুর আগে হযরত আলী (আ.)'র মনে যে চিন্তাটির উদয় হয়েছিল তা এই বস্তু-জগত সম্পর্কিত ছিল না, বরং তা ছিল নিজের ঈমান সম্পর্কিত। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন: " হে আল্লাহর রাসূল! সে সময় আমি কী ঈমানের ওপর অবিচল থাকব? "রাসূল (সা.) বললেন: " হ্যাঁ, সে সময় তোমার ঈমান নিরাপদ থাকবে।

মহানবী আরো বলেন, হে আলী! যে তোমাকে হত্যা করে সে বাস্তবে আমাকে হত্যা করল, যে তোমাকে বিরক্ত করে সে আমাকে বিরক্ত করল এবং যে তোমার অবমাননা করল সে আমার অবমাননা করল, কারণ তুমি আমার আত্মা বা প্রাণের সমতুল্য। তোমার ও আমার মানসিকতা এবং স্বভাব অভিন্ন। নিঃসন্দেহে প্রশংসিত ও গৌরবান্বিত আল্লাহ প্রথমে আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং এরপর সৃষ্টি করেছেন তোমাকে, তিনি প্রথমে বেছে নিয়েছেন আমাকে এবং এরপর বেছে নিয়েছেন তোমাকে। আল্লাহ আমাকে নবুওতের জন্য মনোনীত করেছেন, আর তোমাকে মনোনীত করেছেন ইমামতের জন্য। আর যে তোমার ইমামতকে অস্বীকার করবে সে (কার্যত) আমার নবুওতকে প্রত্যাখ্যান করল।

মহানবী আরো বলেন, হে আলী, তুমি আমার উত্তরাধিকারী, আমার সন্তানদের তথা নাতী-নাতনীর পিতা এবং আমার কন্যার স্বামী আর আমার উম্মতের জন্য আমার জীবদ্দশায় ও আমার মৃত্যুর পর আমার প্রতিনিধি বা খলিফা। তোমার নির্দেশ হল আমারই নির্দেশ, তোমার নিষেধাজ্ঞা হল আমারই নিষেধাজ্ঞা। সেই শক্তির শপথ করে বলছি যেই শক্তি আমাকে নবুওত দান করেছেন এবং আমাকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে তৈরি করেছেন, তুমি হচ্ছ সৃষ্টিকুলের জন্য হুজ্জাতুল্লাহ বা আল্লাহর নিদর্শন এবং তাঁর রহস্যগুলোর আমানতদার বা ট্রাস্টি ও সৃষ্টিকুলের ওপর আল্লাহর খলিফা।" আলী (আ.) জিহাদ থেকে ফিরে আসলে মহানবী (সা.) তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে যেতেন এবং তাঁর মুখের ঘাম মুছে দিতেন নিজ হাতে। তাঁকে জিহাদ বা সফরের সময় বিদায় দিতে গিয়ে তাঁর বিজয়ের জন্য দোয়া করতেন এবং বলতেন: হে আল্লাহ, আলীর সঙ্গে এটাই যেন আমার শেষ দেখা না হয় কিংবা বলেছেন: হে আল্লাহ, আমার মৃত্যুর আগে আলীকে যেন আরো একবার দেখতে পারি। বিশ্বনবী (সা) যখন আলী (আ)-কে এতো গভীরভাবে ভালবাসতেন তখন আমাদেরও উচিত মহানবীর (সা) পথ অনুসরণের চেষ্টা করা।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ