ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩ ১৯:৫৮ Asia/Dhaka
  • সূরা আল-মুনাফিকুন: ৬-১১ (পর্ব-২)

আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা মুনাফিকুনের ৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের আলোচনা শেষ করেছি। কাজেই আজ আমরা এ সূরার বাকি ৫ আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই সূরাটির ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

 هُمُ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ لَا تُنۡفِقُوۡا عَلٰی مَنۡ عِنۡدَ رَسُوۡلِ اللّٰهِ حَتّٰی یَنۡفَضُّوۡا ؕ وَ لِلّٰهِ خَزَآئِنُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَا یَفۡقَهُوۡنَ (৬৩:৭) 

یَقُوۡلُوۡنَ لَئِنۡ رَّجَعۡنَاۤ اِلَی الۡمَدِیۡنَۃِ لَیُخۡرِجَنَّ الۡاَعَزُّ مِنۡهَا الۡاَذَلَّ ؕ وَ لِلّٰهِ الۡعِزَّۃُ وَ لِرَسُوۡلِهٖ وَ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ لٰکِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ. (৬৩:৮) 

এরা হচ্ছে তারা যারা বলে, ‘আল্লাহর রাসূলের কাছে যারা আছে তাদের জন্য ব্যয় করো না যাতে [তারা তার চারপাশ থেকে] সরে পড়ে। অথচ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর ধন-ভান্ডার তো আল্লাহরই। কিন্তু মুনাফিকরা তা বোঝে না।” (৬৩:৭)

“তারা বলে, আমরা মদীনায় ফিরে গেলে সম্মানী ব্যক্তিরা অবশ্যই সেখান থেকে হীন লোকদেরকে বের করে দেবে। অথচ শক্তি-সম্মান তো আল্লাহরই, আর তাঁর রাসূল ও মুমিনদের। কিন্তু মুনাফিকরা এটা জানে না।” ( ৬৩:৮)

গত আসরে মুনাফিকদের বক্তব্য ও আচরণগত কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। আজকের এই দুই আয়াতে তাদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, মুনাফিকরা শুধু যে নিজেরা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে দ্বীনের কাজে সাহায্য করে না তাই নয় বরং অন্যরাও যাতে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীদের যেকোনো ধরনের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকে সেজন্য উস্কানি দেয়। মুনাফিকরা ভাবে, সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলেই তারা আল্লাহর রাসূলের চারপাশ থেকে সরে পড়বে। 

মদীনার জীবনে যেসব মুসলমান মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গিয়েছিলেন তারা অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের দিক দিয়ে চরম অসহায় অবস্থায় ছিলেন। এ সময় রাসূলের নির্দেশে মদীনার একজন করে অধিবাসী যাদেরকে আনসার বলা হতো তারা একজন করে মুহাজিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

কিন্তু মদীনার মুনাফিকরা নিজেদেরকে অন্য সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করত বলে এই অবস্থা তাদের পছন্দ ছিল না। তারা মদীনার প্রকৃত মুসলমানদের বলত: মুহাজিরদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া বন্ধ করে দাও তাহলে দেখবে তারা মক্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হবে। মুনাফিকরা ভাবত, ধন-সম্পদ থাকলেই সম্মান, মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায় এবং দারিদ্র ও অর্থহীন হয়ে গেলেই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে হয়। অথচ ধন-সম্পদ হচ্ছে ধনী ব্যক্তিদের কাছে আল্লাহর আমানত। আল্লাহ দেখতে চান তারা তাদের সম্পদ অসহায় ও দরিদ্র ব্যক্তিদের দান করে কিনা? মানুষের প্রকৃত সম্মান ও লাঞ্ছনা আল্লাহ তায়ালার প্রতি তার ঈমান এবং আমলের ওপর নির্ভর করে; কে কতটা সম্পদশালী তার ওপর নয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- দারিদ্র ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে কোনো মুসলমান যেন তার ধর্মীয় নেতাদের ছেড়ে চলে না যায়। ইসলামের প্রকাশ্য শত্রুদের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিকরা চায় মুসলমানরা চাপের মধ্যে পড়লে তারা যেন তাদের ধর্মীয় নেতাদের চারপাশে জড়ো হওয়া থেকে বিরত থাকে।

২- যারা ধন, সম্পদ, ক্ষমতা ও বস্তুগত চাকচিক্য ছাড়া সম্মান ও মর্যাদার কথা চিন্তা করতে পারে না তাদের পক্ষে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে সম্মান অর্জন করার কথা উপলব্ধি করাই সম্ভব নয়।

৩- যে ব্যক্তি নিজেকে সম্মানিত ও অন্যদেরকে হীন ও নীচ ভাবে তার অন্তরে নিফাকের বীজ বপিত হয়েছে। এরকম মানুষ নিজের চিন্তাধারা সংশোধন না করলে এক সময় পরিপূর্ণ মুনাফিক হয়ে যাবে।

৪- মুমিন ব্যক্তিরা যদি তাদের ঈমানের ব্যাপারে সত্যনিষ্ঠ থাকে তাহলে তাদের সম্মান ও মর্যাদার নিশ্চয়তা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন।  (তাওয়াশিহ)

এবারে সূরা মুনাফিকুনের ৯ থেকে ১১ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (9) وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ (10) وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (11)

“হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ উদাসীন হবে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” (৬৩:৯)

“আর আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে তোমাদের কারও মৃত্যু আসার আগে। (অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে,) হে আমার রব! আমার [মৃত্যুকে] আরো কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে দিলে না কেন, দিলে তো আমি সাদাকাহ [ও যাকাত] দিতাম এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম?” (৬৩:১০)

“আর যখন কারো নির্ধারিত কাল উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ্ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা আমল কর আল্লাহ্‌ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।”  (৬৩: ১১)

এই আয়াতগুলোতে মানুষের অন্তরে নিফাক অনুপ্রবেশের কারণ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা এবং ধন-সম্পদের প্রতি নির্ভরশীলতা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং সে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করে না। এ অবস্থায় বাহ্যিকভাবে একজন মানুষকে মুমিন মনে হতে পারে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে কুফর ও শিরকে লিপ্ত রয়েছে। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের সতর্ক করে দিয়ে বলছেন: পার্থিব জীবনের মোহে পড়ে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ো না। যদি পার্থিব জীবনের মোহে পড়ো তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনের ক্ষেত্রে স্ত্রী, সন্তান এবং ধন সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জনের মতো বিষয়গুলো যেন প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়ায়।

কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু  শয়তান প্রতিটি মানুষকে পার্থিব জীবনের চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শয়তানের এই  ধোঁকাবাজি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি? আল্লাহ তায়ালা নিজেই উপায় বলে দিয়েছেন। তিনি জীবিত অবস্থায় নিজের সম্পদের একাংশ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে সে মৃত্যুর পর এই অনুতাপ না করে যে, হায়াত থাকতে কেন দান-সদকা করিনি এবং যাকাত দেই নি। কারণ, মুত্যুর পর তারা যতই দান করতে চাক না কেন তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। এছাড়া, মৃত্যুর নির্ধারিত সময়ও এক সেকেন্ড পেছানো হবে না। 

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- একজন মুমিন ব্যক্তি মহান আল্লাহকে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দেয় এবং প্রয়োজনে নিজের সমস্ত কিছু আল্লাহর রাস্তায় উজাড় করে দেয়। সেটা হতে পারে ধন-সম্পদ এবং হতে পারে সন্তান-সন্ততি।

২-  পার্থিব জীবনে মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো আল্লাহকে ভুলে যাওয়া এবং তাঁর স্মরণ থেকে বিরত থাকা। অন্য সব ক্ষতির উৎসও এটাই।

৩- মুনাফিকরা মুমিনদেরকে দান-খয়রাত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানালেও আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দান ও সাদাকাহ দিতে উৎসাহিত করেন। মানুষের মধ্যে নিফাক অনুপ্রবেশের মূল কারণ দুনিয়াপ্রীতি। কিন্তু কেবলমাত্র দান-খয়রাত করার মাধ্যমে অন্তর থেকে নিকাফ ও দুনিয়াপ্রীতি দূর করা যেতে পারে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গে দিলেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

 

পার্সটুডে/ এমআইটি/এমবিএ/২৪                                                                                                            

ট্যাগ