আজারবাইজান প্রদেশ: সারব শহর
আমরা ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশ সফর করছি। এই সফরে আজ যাবো “সারব” শহরে। সারব শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে জামে মসজিদটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই মসজিদটি খ্রিষ্টিয় পণেরো শতকের স্মৃতিবাহী। সারব জামে মসজিদটি ইরানের অপরাপর মসজিদের চেয়ে একটু আলাদা, কেননা এই মসজিদের কোনো উঁচু মিনার নেই। তবে বড়ো শাবেস্তান আছে তিনটি মেহরাব সম্পন্ন। বর্ণনায় না গিয়ে চলুন সরাসরি চলে যাওয়া যাক সারব শহরটিতে।
পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পূর্বে সারব শহরটি অবস্থিত। এই শহরটি উত্তর , পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে সাবালন পর্বতমালা, বোযকুশ পর্বতমালা এবং ইলানজুগ্ব চূড়া পরিবেষ্টিত। এ কারণে এ শহরটি অনেকটা সমতল প্রান্তরের মতো। এখানে পৌঁছার একটাই পথ খোলা আছে পূর্ব দিক থেকে। ভৌগোলিক দিক থেকে এই শহরটির ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। এই গুরুত্বের কারণ হলো এখানকার চমৎকার আবহাওয়া। শীতকালে এখানকার আবহাওয়া থাকে ঠাণ্ডা এবং পার্বত্য আর গ্রীষ্মকালে থাকে নাতিশীতোষ্ণ। শীতকালে তো এখানে ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকেই, গরমকালেও ঠাণ্ডা আবহাওয়া বিরাজ করে বলে এই এলাকাটি ইরানের অন্যতম একটি শীতপ্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানকার উঁচু চূড়া সারা বছর জুড়েই থাকে বরফে ঢাকা। আকাশ থেকে অবতীর্ণ আল্লাহর এই রহমতের শীতল ধারা তাই বয়েই চলছে অবিরাম।
সাবালানের উৎসমূল থেকে সৃষ্ট ধারাগুলো এক জায়গায় এসে হয়ে উঠেছে নদী। এই নদীর নাম ‘অজি চয়ি’ নদী। এ এলাকায় সমৃদ্ধ এক চারণভূমি থাকায় আজারবাইজান প্রদেশের উপজাতিদের জন্যে খুবই উপযোগী একটি অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। কেননা চারণভূমি উপজাতিদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। উপজাতিরা যেহেতু পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করে সেজন্যে পশু চরানোর ব্যবস্থাটা না থাকলে তাদের জন্যে যথার্থ জীবন যাপন করাটা দরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই চারণভূমি থাকার কারণে সারব এখন হয়ে উঠেছে আজারবাইজান প্রদেশের উপজাতিদের জন্যে খুবই উপযোগী একটি এলাকা। এ এলাকার পশুগুলোও সার্বিক থেকেই বেশ উন্নতমানের। পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের কেন্দ্রিয় বা গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর একটি হলো সারব। এর কারণ হলো বিভিন্ন দিকের যোগাযোগের রাস্তা বা সড়কপথ এই সারব হয়েই গেছে। অর্থাৎ সারবকে ক্রস না করে এই প্রদেশের খুব কম পথই গেছে।

আর যোগাযোগের সংযোগ স্থাপন করার কারণেই সারব শহরটি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। আরো একটি কারণে অতীতকালেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই শহরটি। কারণটি হলো সৈন্য সামন্ত আর বাণিজ্যিক কাফেলার আসাযাওয়ার পথে এই শহরটি পড়তো। এমনকি মোঙ্গলদের শাসনকালেও আজারবাইজানের প্রশাসন পরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল সারব। সাফাভি রাজবংশের শাসনামলের প্রথম দিকে তাব্রিয এবং আর্দেবিল গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে পরিগণিত ছিল। সে সময় সারব শহরটিও যেহেতু এই দুই শহরের কাছেই ছিল সেহেতু এ শহরটিও বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখতো। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে ওসমানী সেনাদের সাথে খলিল পাশার নেতৃত্বে শাহ ইসলাইল সাফাভির যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ঐ যুদ্ধটি সারব শহরেই ঘটেছিল।
সারব শহরটি ইরানের ঐতিহাসিক শহরগুলোর মধ্যে একটি। এই শহরে উরা’তুহা যুগ অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম থেকে অষ্টম শতকের মাদ্দের সময়কার বহু নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। এইসব নিদর্শনই প্রমাণ করে শহরটি অনেক প্রাচীন। ভূগোলবিদ এবং ভূবন পর্যটকদের অনেকের লেখাতেই সারব শহরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হামদুল্লাহ মুস্তাওফি’র লেখা নুজহাতুল কুলুব বইতেও সারব শহর প্রসঙ্গটি এসেছে। হামদুল্লাহ মোস্তাওফি ছিলেন ইরানী বিশিষ্ট ভূগোলবিদ এবং ইতিহাসবিদ। ৭৪০ হিজরিতে লেখা তাঁর এ বইটিতে সারব শহরের অবস্থান ,এখানকার আবহাওয়া এবং এখানে উৎপাদিত শস্য পণ্য সামগ্রী সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। বিশিষ্ট আরব পর্যটক ইবনে হোকালও খ্রিষ্টিয় দশম শতাব্দিতে সারব শহরের বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনায় কৃষিজ পণ্য, ফল বাগান এবং অতিথিশালাসহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাজারঘাটের কথা উঠে এসেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়টি হলো এই শহরটিও মোঙ্গলদের হামলার শিকারে পরিণত হয়েছিল। ১২২০ খ্রিষ্টাব্দে তাদের হামলায় সারব শহরটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং হত্যা লুণ্ঠনসহ বিচিত্র লুটতরাজের ফলে শহরটি তার সৌন্দর্য হারায়। তারপরও কিছু কিছু নিদর্শন এবং ধ্বংসাবশেষের নমুনা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে যেগুলো এই শহরের প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

সারব শহরের দুই কিলোমিটার উত্তরে ‘কেল্লে জোক’ নামে একটি টিলা রয়েছে। এই টিলাটির নামকরণ করা হয়েছে এখানকার একটি দূর্গ থেকে। ঐ দূর্গটির নাম ছিল ‘কেল্লে জোক’ দূর্গ। বর্তমানে সেই নামের ঐতিহ্য রক্ষার্থে টিলাটিও ‘কেল্লে জোক’ নামেই পরিচিত। কেল্লাটির অস্তিত্বে এখন কাঁচা ইটের দেয়াল শোভা পাচ্ছে। দেয়ালটি কোথাও কোথাও পাঁচ মিটার পর্যন্ত উঁচু। এই কাঁচা ইটের দেয়াল এবং ইটগুলোর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে বোঝা গেছে যে কেল্লাটি খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম থেকে অষ্টম শতকের নিদর্শন। এছাড়াও এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে বহু পুরোণো জিনিসপত্র। আবিষ্কৃত জিনিসগুলোর মাঝে বিচিত্র মৃৎপাত্রও রয়েছে। এইসব মৃৎপাত্র খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকে ইসলামের প্রাথমিক শতকের বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
সারব শহরের অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে এই শহরের জামে মসজিদের কথা উল্লেখ করা যায়। এই মসজিদটির আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে। এই মসজিদটিও ইরানের মসজিদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য থেকে একটু আলাদা। আলাদা এ কারণে যে এই মসজিদটিতে বিশাল এবং উঁচু কোনো মিনার নেই। তবে বড়ো শাবেস্তানে আছে তিনটি মেহরাব। খ্রিষ্টিয় পণেরো শতকের স্মৃতিবাহী এই মসজিদটি ১৯৬৮ সালে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের নিদর্শনের তালিকাভুক্ত হয়েছে।
ইরানের ঐতিহ্যবাহী যেসব নিদর্শন পর্যটকদের আকর্ষণ করে সেসবের একটি নিদর্শন এই সারব শহরেই রয়েছে। নিদর্শনটি হলো পূর্ব আজারবাইজানের উপজাতীয় যাদুঘর। এই যাদুঘরটি কেবল সারবেরই নয় বরং সমগ্র ইরানেরই অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। যাযাবর জীবনের বিচিত্র নিদর্শন যেমন এই যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে তেমনি আছে কয়েক হাজার বছরের ইরানী উপজাতীয়দের বিচিত্র উদ্ভাবনীর প্রদর্শনীর আয়োজনও। সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে যাযাবর এবং উপজাতীয় শ্রেণী যে কতোভাবে ভূমিকা রেখেছে তার প্রামাণ্য দলিল সম্পর্কে একটা ধারণা হবে এই মিউজিয়ামটি ভালোভাবে দেখলে।
সারবে আছে ঐতিহাসিক ‘জালাল’ হাম্মাম। কাজারি আমলের এই হাম্মামটিও গুরুত্বের বিবেচনায় ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।*
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/২৭/টি-৪২/অ-৪৪